নেপালে বাংলাদেশি বিমান দুর্ঘটনা, অর্ধেকের বেশি যাত্রী নিহত
2018.03.12
ঢাকা

আপডেট: ১২ মার্চ, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৪.০০
বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (টিআইএ) রানওয়ের কাছে বিধ্বস্ত হয়েছে।
“দুর্ঘটনা কবলিত উড়োজাহাজের ৭১ আরোহীর মধ্যে ২২ জন জীবিত আছেন,” বলেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (আইসিটি) নাবিদ মোস্তফা জিসান।
বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে ১০টায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এ কথা বলেন। তাঁর দেয়া হিসাব অনুযায়ী, মৃত আরোহীর সংখ্যা ৪৯।
নিহতদের মধ্যে পাইলট ও ক্রুসহ বাংলাদেশের ২৫ এবং নেপালসহ অন্য দেশের ২৪ জন।
“জীবিত যাত্রীদের মধ্যে ৯ জন বাংলাদেশি রয়েছেন,” উল্লেখ করেন নাবিদ মোস্তফা।
বিমানটির ৭১ আরোহির মধ্যে ৩২ জন যাত্রী ও চার বৈমানিকসহ মোট বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৩৬।
এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর ফেসবুকে নিহত ও আহত বাংলাদেশি যাত্রী ও বৈমানিকদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন।
“পাইলট আবিদ হাসান নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। একজন ক্রু বেঁচে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কো পাইলট ও অপর একজন ক্রু নিহত হয়েছেন,” জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
দুর্ঘটনার কারণ 'ভুল বার্তা'!
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ তাঁদের ঢাকাস্থ কার্যালয়ের সামনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, “বিমানটি পরিচালনা করছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ও ফাস্ট অফিসার পৃথুলা রশিদ। দুর্ঘটনায় আহত ১৬ জন নেপালের চারটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানও রয়েছেন।”
“আবিদ সুলতান খুবই দক্ষ বৈমানিক” উল্লেখ করে তিনি জানান, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের কথোপকথনের রেকর্ড তাঁদের কাছে রয়েছে। যা শুনে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এখানে পাইলটের কোনো দোষ ছিল না।
“বিমানটি উড্ডয়নের আগে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়েছিল। এটিতে কোনো ত্রুটি ছিল না,” বলেন ইমরান আসিফ।
তিনি বলেন, “অবতরণের সময় আমাদের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ভুল বার্তা দেয়া হয়েছিল।”
তবে নেপালের একটি নিউজ পোর্টালের সম্পাদক সুদীপ শ্রেষ্ঠা বেনারকে জানান, “দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে টিআইএ কর্তৃপক্ষ বলছে ট্রাফিক, কন্ট্রোল ও এয়ারক্রাফটের মধ্যে কিছুটা মিসকমিউনিকেশন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা আগেই বিমানটি বন্দরে চলে আসে।”
এদিকে বিমান ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার টুয়েন্টিফোর ডটকম বলেছে, “এয়ারক্রাফটির বয়স হয়েছিল ১৭ বছর।”
এ ঘটনায় নেপালের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টিআইএ’র সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বলে জানায় স্থানীয় দৈনিক কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদন।
৬৭ যাত্রী, ৪ বৈমানিক; বেশিরভাগ বাংলাদেশি
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল অ্যাভিয়েশন) বলছে, “দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭১ জন আরোহী নিয়ে এটি ছেড়ে যায়। নেপালে পৌঁছানোর পর স্থানীয় সময় ২টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৩টা ৫ মিনিট) এটি বিধ্বস্ত হয়।”
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী একেএম শাজাহান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “৭৬ সিটের বিমানটিতে ২ জন পাইলট, ২ জন কেবিন ক্রুসহ মোট ৭১ জন আরোহী ছিলেন। ৬৭ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৭ জন পুরুষ, ২৭ জন নারী ও ২ জন শিশু ।”
“যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশি ৩২, নেপালি ৩৩ এবং মালদ্বীপ ও চীনের ১ জন করে নাগরিক আছেন, আর ক্রুদের সকলেই বাংলাদেশি,” উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
এদিকে ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের একটি দল নেপাল যাবে বলে এক তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সংস্থটির চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান।
জানালা ভেঙে বেঁচেছেন বসন্ত
নেপালে বিধ্বস্ত ইউএস বাংলার নেপালি যাত্রী বসন্ত বোহরা কাঠমান্ডুর সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমার আসনটি ছিল বিমানের জানালার কাছে। তাই আমি জানালা ভেঙে বের হতে পেরেছিলাম।”
“ঢাকা থেকে বিমানটি উড্ডয়নের সময় সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় এটি অদ্ভুত আচরণ করছিল।” সংযুক্ত করেন নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই যাত্রী। তাঁর মাথায় ও পায়ে আঘাত লেগেছে।
তাঁর বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, যাত্রীদের মধ্যে তিনিসহ ১৬ জন নেপালের বিভিন্ন ট্রাভেল সংস্থার হয়ে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন।
এছাড়া, বিমানে থাকা নেপালী যাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে অধ্যায়নরত ১৩ জন শিক্ষার্থী ছিলেন বলে বেনারকে জানান সুদীপ শ্রেষ্ঠা।
বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল একাত্তরকে সুব্রত দাস নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, “ইউ-এস বাংলার এই বিএস-২১১ ফ্লাইটে ঢাকা ফেরার জন্য আমরা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলাম। বিমানটিকে আমরা নামতেও দেখি।”
“প্রচণ্ড গতি নিয়ে বিমানটি অবতরণ করে, সাথে সাথেই আগুন ধরে যায়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এটি রানওয়ে থেকে কমপক্ষে ১০০ মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। পুরো ঘটনাটি আমাদের চোখের সামনে ঘটে।”
নেপালের দৈনিক কাঠমান্ডু পোস্টকে টিআইএ’র মুখপাত্র প্রেমনাথ ঠাকুর বলেছেন, “বিধ্বস্ত হবার পরই বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানবন্দরের উদ্ধারকারী দল এবং নেপাল সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছেন।”
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
কাঠমান্ডুতে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের এ ঘটনায় পৃথক বিবৃতিতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোকবার্তায় তাঁরা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনার পাশপাশি আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
এছাড়া চার দিনের সফরে গত রোববার থেকে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরসূচি সংক্ষিপ্ত করে পূর্বনির্ধারিত সময়ের একদিন আগে, মঙ্গলবারই দেশে ফিরছেন।
ইতিমধ্যে সোমবার সিঙ্গাপুর সময় রাত পৌনে আটটার দিকে তিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি অলির সাথে ফোনে কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উইং থেকে বাংলাদেশী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, “ফোনালাপে নেপালের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুর্ঘটনার পরপরই তিনি ঘটনাস্থলে গিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।”
“ত্রিভুবন বিমানবন্দর খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহায্যকারী দল নেপালে পাঠাবেন। প্রয়োজনীয় যত রকমের সাহায্য দরকার বাংলাদেশ তা দেবে,” নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে বলেছেন শেখ হাসিনা।
এদিকে এই ঘটনায় জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ মন্ত্রী পরিষদের বিভিন্ন সদস্য পৃথক পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন।
নিহত ও আহত বাংলাদেশি যাত্রী
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত বাংলাদেশিদের নামের তালিকা দিয়েছেন।
নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া এই তালিকা অনুযায়ী নিহত ২৩ বাংলাদেশি যাত্রী হলেন, অনিরুদ্ধ জামান, সানজিদা হক, মো. রফিকুজ্জামান, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, এফ এইচ প্রিয়ক, বিলকিস আরা, বেগম হারুন নাহার বিলকিস বানু, আক্তার বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, আঁখি মণি, মেহনাজ বিন নাছির, ফয়সাল আহমেদ, মো. রকিবুল হাসান, ইয়াকুব আলী, আলিফুজ্জামান, মো. হাসান ইমাম, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, পিয়াস রায়, মো নুরুজ্জামান ও উম্মে সালমা।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে ওম হাসপাতাল চিকিৎসাধীন আছেন মো. রেজোয়ানুল হক।
বাকি আটজন আছেন কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাঁরা হলেন, সৈয়দা কামরুন নাহান স্বর্ণা, আলমুন নাহার অ্যানি, ইমরানা কবীর হাসি, শাহরিন আহমেদ, মো. শাহীন ব্যাপারী, মেহেদী হাসান, মো. কবীর হোসেইন ও শেখ রাশেদ রুবায়েত।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী ও জেসমিন পাপড়ি।