সরকারের তিন বছর পূর্তি: বেড়েছে উন্নয়ন, কমেছে গণতন্ত্র
2017.01.11

সহিংসতা কাটিয়ে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং বেশ কিছু উন্নয়ন সাফল্য নিয়ে ১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার তিন বছর পূর্ণ করতে চলেছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কিন্তু গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা কাটেনি, বরং তা জোরালো হচ্ছে। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে।
নির্বাচন বয়কট করেও প্রতিহত করতে না পারা এবং আন্দোলনের নামে সহিংসতা করার অভিযোগে কোণঠাসা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাজপথে শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর অবস্থায় নেই।
এই অবস্থায় সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করাকে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা। তবে সরকার বলছে, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নের দিকেই তাদের নজর এখন বেশি। এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকা, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ১৫৩ টি সংসদীয় আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ীদের নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
বাকি ১৪৭ সংসদীয় আসনে নির্বাচন হলেও তা ছিল আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের নিজেদের মধ্যে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১২৭ টি, জাতীয় পার্টি ১৮ টি, জেপি ১ টি, জাসদ ৩ টি এবং ওয়ার্কার্স পাটি ২ টি আসন পায়।
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি একাধারে সরকারে এবং বিরোধী দলে অবস্থান নেয়। নির্বাচনের এক বছর পর সংসদ থেকে ছিটকে পড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সহিংস আন্দোলন শুরু করে। সহিংসতায় এবং পেট্রল বোমার আগুনে পুড়ে প্রায় একশ মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় শত শত সাধারণ নাগরিক।
কমেছে দারিদ্র
মঙ্গলবার (৯-১০-২০১৭) প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে পূর্বাভাস করা হয়েছে, চলতি অর্থবছর (জুলাই ২০১৬-জুন ২০১৭) জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। ব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছর দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হবে তৃতীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. এম আখতারুজ্জামান বেনার নিউজকে বলেছেন, “অর্থনীতির সবগুলো সূচক ২০১৬-১৭ অর্থবছরের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় আমরা মনে করছি আগামী বছরে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।”
বিশ্বব্যাংকের আর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। মাথাপিছু বার্ষিক আয় এক হাজার ৪৬৫ ডলারে পৌঁছে যাওয়ায় এ বছর জুলাই মাসে বিশ্ব ব্যাংক তাদের তালিকায় বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে তুলে এনেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক জায়েদ বখত বেনার নিউজকে বলেছেন, “অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল। প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা বজায় রেখে বর্তমানে সেটা ৭ শতাংশ অতিক্রম একটি বড় অর্জন। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখাও আরেকটি সাফল্য।”
তবে রিজার্ভ এবং রপ্তানি আয় বাড়লেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নগতি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং এবং ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলাকে সমস্যা হিসেবে দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ।
নির্বাচনমুখী বিএনপি
দু’বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সম্প্রতি দেখা করে দলীয় প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, “আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা এখন আর বলছি না। নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা আমরা সময়মতো তুলে ধরব। আপাতত: নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি। দেখতে চাই সরকারের সিদ্ধান্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনার কতটুকু প্রতিফলন ঘটে।”
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রপতির কিছু করার ক্ষমতা নেই। কারণ, সংবিধানেই বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।”
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেনে নেবে আওয়ামী লীগ।
স্বকীয়তার সন্ধানে জাতীয় পার্টি
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বর্তমান নির্বাচনমুখী অবস্থানকে ইতিবাচক ও গণতন্ত্রের জন্য সম্ভাবনায় হিসেবে দেখছেন জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জিএম কাদের। বেনার নিউজকে তিনি বলেছেন, “আমি বর্তমান অবস্থাকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ই একগুঁয়েমি থেকে সরে এসেছে।”
জাতীয় পার্টির অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, “২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে এরশাদ সাহেব রাজি ছিলেন না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কখনই ভালো নির্বাচন হবে না, এটা সবাই জানত। আপনারা সরকার ও বিরোধী দলে থাকার যে দ্বৈতনীতি দেখেছেন, তা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন আমরা আমাদের স্বকীয় অবস্থানে ফিরতে চাচ্ছি।”
জঙ্গিবাদ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত
সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের বিকাশ এবং জঙ্গিবাদের উত্থানকে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, “মানুষের বাক স্বাধীনতা এবং পলিসি বিতর্কের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় মানুষের চিন্তার প্রতিফলন না ঘটলে গণতন্ত্র হয় না।” তার মতে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।
তবে বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের কোনো সংকট আছে বলে মনে করেন না আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মণি । বেনার নিউজকে তিনি বলেছেন, “দেশে গণতান্ত্রিক সরকার বহাল আছে। সংসদ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়। তবে গণতন্ত্রকে আরও উন্নত করার নিশ্চয়ই সুযোগ আছে।”