প্রশ্নফাঁস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত
2019.05.30
ঢাকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ১২৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এদের মধ্যে ৮৭জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাদের ১৮ জন পুলিশের হাতে আটক রয়েছেন।
সিআইডিপ্রধান ও অতিরিক্ত আইজি মোহা. শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। ঈদুল ফিতরের পরে এই অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রায় দেড় বছর তদন্তের পর আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হলো। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের এই দায় কোনোভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পুরা দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রশ্ন ফাঁসের জন্য যে রকম ফাঁক ফোকর তৈরি হয়েছে সেগুলোর সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ তাদের নেই।”
তিনি বলেন, “ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা অনুযায়ী প্রশ্ন প্রণয়ন, তৈরি, মুদ্রণ, বণ্টনসহ পুরো প্রক্রিয়াতেই খুব সুনির্দিষ্ট লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া থাকে। তাদের মধ্য থেকে যদি কেউ শিথিলতা বা অনিয়ম না করে তাহলে প্রশ্ন ফাঁস অসম্ভব।”
তবে এসব অপরাধীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী।
তিনি বেনারকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সক্রিয়। সিআইডির সাথে পুরো প্রক্রিয়া আমরা অবহিত আছি। অপরাধীদের শনাক্ত করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে সাহায্য করছি।”
চার্জশিটে অন্তুর্ভুক্ত ৮৭ জনের মধ্যে ১৫জনকে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান প্রক্টর।
গোলাম রব্বানী বলেন, “তদন্তকারী সংস্থা আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল করবে। সেই নাম এবং তালিকা পাওয়া সাপেক্ষে পূর্বের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বাকিদেরও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে খুব শিগগির চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডি প্রধান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মনির হোসেন বলেন, “যেকোনো পরীক্ষার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নেয় কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থী। অথচ প্রশ্ন ফাঁস করে অমেধাবীরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।”
“এটা মেধাবীদের সাথে এক ধরনের প্রবঞ্চনা। এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত,” বলেন মনির।
অভিযোগপত্রভুক্ত ৪৭ জন গ্রেপ্তার
সিআইডিপ্রধান শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগপত্রভুক্ত ১২৫ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৭ জনকে। এদের মধ্যে ৪৬ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, অভিযোগপত্রে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন ছাত্রের মধ্যে ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি ৪৯ জন শিক্ষার্থীসহ ৭৮ জন আসামি পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
“এছাড়াও আরো কয়েকজনের বিষয়ে অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে পরে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হবে,” বলেন শফিকুল আলম।
টানা অভিযানের কারণে এবার এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রশ্নফাঁস হয়নি বলেও দাবি সিআইডির।
জালিয়াত চক্র
২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। এর আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক মহিউদ্দিন রানা ও আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন পরীক্ষার হল থেকে গ্রেপ্তার হন রাফি নামের এক ভর্তি পরীক্ষার্থী। এদের কাছে এটিএম কার্ডের মতো দেখতে এক ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস পাওয়া যায়। যা দিয়ে পরীক্ষা চলাকালে কানে অপর একটি ডিভাইস রাখা পরীক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশ্নোত্তর বলে দেওয়া হয়।
২০ অক্টোবর তাঁদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করে সিআইডি। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের বাকিদের গ্রেপ্তার করে।
এই চক্র দুইভাবে পরীক্ষায় অসদুপায়ে জড়িত ছিল জানিয়ে সিআইডি প্রধান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “একটি চক্র প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তা চড়া দামে বিক্রি করে। অন্যটি চক্রটি ক্ষুদ্র ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠানো ও ভেতরে পরীক্ষার্থীকে উত্তর বলে দেওয়ার কাজ করত।”
অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল তদন্তের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করে বলে জানান শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, এই চক্রের প্রধান দুজন হলেন নাটোর জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এছামী ও বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস। তাঁরা এখন কারাগারে।