নোয়াখালীতে বিবস্ত্র করে নারীকে নির্যাতন: সমালোচনার মুখে সরকার
2020.10.05
ঢাকা

দুই সন্তানের জননীকে (৩৫) বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। সিলেটে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় নোয়াখালীর এ ঘটনাটি সামনে আসায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার বলেন, “এটার দায় আমরা এড়াতে পারি না।”
এ ধরনের প্রত্যেকটি বিষয়ে “সরকার দায়িত্ব নিচ্ছে,” দাবি করে তিনি জানান, এমন ঘটনায় তাঁর দলের কেউ জড়িত থাকলেও তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে নোয়াখালীর ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে সোমবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নেমেছে মানুষ। শাহবাগ মোড় ও উত্তরার হাউজ বিল্ডিং চৌরাস্তা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠন।
“রাস্তায় নেমে আসতে হবে। সরকারকে জানান দিতে হবে এভাবে আর চলতে পারে না। এই সরকারের কাছে মা-বোন সুরক্ষা পাচ্ছে না,” শাহবাগে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন বিক্ষোভকারী বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নেত্রী মাকসুরা আক্তার।
নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের ব্যানারে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবীন আহসান বেনারকে বলেন, “পুলিশ, প্রশাসন, রাষ্ট্র এক অর্থে ব্যর্থ। তারা এ জাতীয় ঘটনা বন্ধই করতে পারছে না। যে কারণে এখন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাটা জরুরি।”
“সমাজের প্রত্যেককে ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা শহরেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), নারীপক্ষ, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স, প্রাজ্ঞস্বর, সিডাব্লিউসিএস এবং উই ক্যানসহ বিভিন্ন সংগঠন।
সিলেট এবং নোয়াখালীর দুটি ঘটনাতে ক্ষমতাসীন দল এবং এর অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলছেন অনেক বিক্ষোভকারী।
এ ব্যাপারে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সোমবার বলেন, “ধর্ষকরা যে পরিচয়ই ব্যবহার করুক, তাদের কঠোর হাতে দমন করার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপকতা না থাকায় আগে এমন অনেক ঘটনা আড়ালে থেকে যেত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন প্রায় সব ঘটনাই প্রকাশ্যে আসে। এ বিষয়টি ভালো।”
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
বন্ধ ঘরে টর্চলাইটের আলোয় বিবস্ত্র এক নারীকে টেনে হিঁচড়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা ও মারধর করা হচ্ছে, আর তিনি তারস্বরে চিৎকার করছেন, “ওরে আব্বারে– তোগো আল্লার দোহাই, আমারে ছাইড়া দে।” এমন দৃশ্য সম্বলিত ‘ভাইরাল’ হওয়া ভিডিওর সূত্র ধরেই নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীকে (৩৫) খুঁজে বের করে পুলিশ।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের ওই ঘটনার ৩২ দিন পর রোববার রাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন নির্যাতিতা।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের ওই দুই মামলার প্রধান আসামিসহ মোট চার অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে।
“বাকি অভিযুক্তদের ধরতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,” সোমবার দুপুরে বেনারকে বলেন নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন।
তিনি জানান, এ ঘটনায় জড়িত জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের আবদুর রহিম (২২) ও রহমত উল্যাহকে (৪১) রোববার বিকেলেই গ্রেপ্তার করে বেগমগঞ্জ থানা পুলিশ।
পরে সোমবার ভোরে ঢাকার কামরাঙ্গীচর থেকে প্রধান আসামী মো. নুর হোসেন বাদল (২০) এবং তার আগে রাত আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার চিটাগাং রোড থেকে মো. দেলোয়ার হোসেনকে (২৬) গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
র্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুর আলম সাংবাদিকদের জানান জানান, এ ঘটনায় সম্পৃক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান দেলোয়ার। তাঁর কাছ থেকে একটি পিস্তল, ম্যাগাজিন এবং দুই রাউন্ড গুলিও উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের দাবি, দেলোয়ার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তাঁর বাহিনী চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং নানান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত এবং তাঁদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীত-সন্ত্রস্ত। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে আগের দুটি হত্যা মামলাও রয়েছে।
নির্যাতিতা নারী অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় অপরাধিরাই ভিডিওটি প্রকাশ করেছে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে।
যা ঘটেছিল জয়কৃষ্ণপুরে
নির্যাতনের ঘটনাটি মূলত গত ২ সেপ্টেম্বরের। মামলার এজাহার বলা হয়েছে, সেদিন রাত নয়টার দিকে নিজের ঘরের শয়ন কক্ষে স্বামীর সাথেই ছিলেন নির্যাতিতা। ওই সময় আসামিরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তাঁর স্বামীকে মারধর করে পাশের রুমে নিয়ে বেঁধে রাখে।
এরপর তাঁকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁকে মারধর ও পাশবিক নির্যাতন করা হয়। বিবস্ত্র অবস্থায় তাঁর ভিডিও ধারণ করে রাখে তারা। পরে তাঁর চিৎকারে আশেপাশের মানুষ এগিয়ে আসলেও কাউকে কিছু বললে প্রাণনাশের হুমকী দেয় নির্যাতনকারীরা।
এ ঘটনা চেপে রেখেই এলাকা ছেড়ে পাশের উপজেলায় নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন ওই নারী। এরপর আসামিরা তাঁর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাঁকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হলে তাঁর বিবস্ত্র ভিডিও ফেসবুকে প্রচার করবে বলেও হুমকি দেয়।
ভিডিওটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশ তাঁকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসা করলে তিনি পুরো ঘটনাটি জানান। এরপর স্বজনদের সাথে আলোচনা করে মামলা করেন। ঢাকায় বিক্ষোভকারী রবীন বেনারকে বলেন, “এ থেকেই বোঝা যায় পুলিশ, আইন বা বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাঁর (নির্যাতিতা) কোনো ভরসা ছিল না।”
ভিডিও অপসারণের নির্দেশ
ভিডিওটি সিডি বা পেনড্রাইভে কপি রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সোমবার এই আদেশ দেন।
“এক মাস এই ঘটনা চাপা থাকল কী করে, পুলিশ কী করছে?,” এমন প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট বলে, “ফেসবুকে না ছড়ালে তো ঘটনা গোপনই থাকত।”
এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীর এসপি বেনারকে বলেন, "কোনো অপরাধের ঘটনা আমরা না জানলে কীভাবে ব্যবস্থা নেব? এই ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের যারা বিষয়টি জানত, তারা কেউই পুলিশকে জানায়নি। ‘ভিকটিম’ (নির্যাতিতা) এবং তাঁর পরিবারও ভয়ভীতির কারণে চুপ ছিল। যে কারণে বিষয়টি আমরা জানতেই পারিনি।”
তবে ঘটনাটি জানা মাত্রই পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এক নারী (১৮) গণধর্ষণের শিকার হন। স্বামীকে বেঁধে রেখে দুষ্কৃতিরা ওই নারীকে ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।
এই ঘটনায় ওই নারীর স্বামী নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এজাহারভুক্ত ছয়জনসহ পুলিশ এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের সবাই ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।
প্রতিদিন তিনটি করে ধর্ষণ
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর বেনারকে জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন তিনটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
“এ বছর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন আরো ১২ জন নারী,” বলেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেবেও নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. সোহেল রানা বেনারকে জানান, গত বছরের প্রথম ছয়মাসে এক হাজার ১৯টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছিল, আর এ বছর প্রথম ছয় মাসে হয়েছে এক হাজার ৮০ টি।
দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা নোয়াখালীতে সরকার বিরোধীদের ভোট দেওয়ার দায়ে বিগত জাতীয় নির্বাচনের রাতেই চল্লিশোর্ধ এক গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
“নির্বাচনের সময়ের ওই ঘটনার পর দীর্ঘদিন কিন্তু জেলাতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি,” বলে এসপি আলমগীর।
“ওই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন কিন্তু আমরা অনেক আগেই আদালতে জমা দিয়েছি। কিন্তু কোভিড মহামারির কারণে বিচার এখনও শেষ হয়নি,” বলেন তিনি।
এত দিনে ওই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে এমন ঘটনা ঘটত না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।