ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রেখে সংশোধন হচ্ছে আইন

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.09
ঢাকা
201009_Rape_Protest-Bangla_1000.jpg সারা দেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও সহিংসতার প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে টানা পঞ্চম দিনের বিক্ষোভ। ৯ অক্টোবর ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে ছাত্র ও সামাজিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ–সমাবেশ। এরই মধ্যে সরকার বলেছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড।

তবে এই ঘোষণার পরও ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ হয়নি। বাংলাদেশে ধর্ষণ বন্ধের দাবিতে চলমান বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে বিবৃতি দিয়ে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত নারীদের কথা শোনা।”

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে

শুক্রবার এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ ধর্ষকদের কোনো প্রকার আশ্রয়–প্রশ্রয় দেয় না।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ধর্ষণের সাজা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইন সংশোধন করার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন পাশ করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিনে সারা দেশে কমপক্ষে তিন ডজনের মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এই লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। আর ধর্ষণের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক আশ্রয়–প্রশয়। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনাই এর প্রমাণ।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

নতুন ধর্ষণের ঘটনা

ঢাকার আশুলিয়ায় তিন শিশুকে ভালো খাবার দিয়ে ধর্ষণের দায়ে শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে হেলাল উদ্দিন (৫৭) নামে এক বাড়িওয়ালাকে। বেনারকে এই তথ্য জানিয়েছেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম কামরুজ্জামান।

ফেনীর সোনাগাজীতে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে শুক্রবার স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক বহিস্কৃত নেতা তমিজ উদ্দিন নয়নকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান সোনাগাজী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রহিম সরদার। তাঁকে আদালতে তোলা হলে সাতদিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।

এ ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে যশোরের মনিহার এলাকায় বাসের মধ্যে এক নারীকে ধর্ষণ করেন পরিবহন শ্রমিক মো. মনিরুজ্জামান। আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ।

এছাড়া চট্টগ্রামে রিকশা থেকে নামিয়ে এক নারীকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের দায়ে আটজনকে পুলিশ আটক করেছে বলে শুক্রবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটান পুলিশের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক।

‘মৃত্যুদণ্ড প্রয়োজন’

নারী অধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বেনারকে বলেন, “একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে আমি মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করি না। তবে যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে তাতে আমার মনে হয় এখানে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ড হলে কিছুটা হলেও ভয় বাড়বে, ধর্ষণের ঘটনা কমবে।”

তিনি বলেন, “মূলত রাজনৈতিক আশ্রয়–প্রশ্রয়ে আমাদের দেশে ধর্ষণের বিচার হয় না। যারা ধর্ষণকারী তারা এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেটি গেল একটি দিক।”

“আরেকটি দিক হলো, ধর্ষণের মামলাগুলো দুর্বল প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করার ফলে বিচার হয় না। তদন্ত প্রতিবেদন এমনভাবে করা হয় যাতে ধর্ষণকারীরা সুবিধা পায়। এমন ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হলে আদালতের কিছু করার থাকে না। আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়।”

‘বিচার দীর্ঘায়িত হওয়ায় আলামত নষ্ট হয়ে যায়’

বাংলাদেশে ধর্ষণের বিচার যে একেবারে হয় না, তা নয়, মন্তব্য করে ঢাকা বারের সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “যারা নিয়মিত মামলা চালিয়ে যান, সাক্ষ্য দিতে আসেন তাঁদের মামলায় সাজা হয়।”

তাঁর মতে, বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার পরিবারগুলো সাধারণত খুবই দরিদ্র, ক্ষমতাহীন হয়ে থাকে। তারা আসামিদের সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে পারবে না বিধায় আপোস করে ফেলে। এছাড়া সমাজেও সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের বিচার করে আপোস করার কথা বলা হয়।

“অধিকাংশ মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায় আসামিরা প্রভাবশালী, বিত্তশালী হওয়ায় পুলিশ সময়মতো আসামিকে আদালতে উপস্থাপন করে না। আদালতের পেশকারের সহায়তায় দিনের পর দিন মামলার তারিখ পেছাতে থাকে,” বলেন প্রকাশ বিশ্বাস।

তিনি বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে বিচার হতে হবে ১৮০ দিনে মধ্যে। ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ করা না গেলে উচ্চ আদালতের কাছে তা ব্যাখা করে জানাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে মামলা ১৮০ দিনে তো হয়ই না; এমনকি উচ্চ আদালতকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয় না।”

“বিচার দীর্ঘায়িত হওয়ায় অনেক ভিকটিম ও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসে না, আলামত নষ্ট হয়ে যায়,” বলেন তিনি।

তাঁর মতে, “ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হলে সমাজে ধর্ষণ কমবে বলে মনে করা হলেও আসলে তা কমবে বলে মনে হয় না।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমর্থন

বাংলাদেশে ধর্ষণ বন্ধের দাবিতে চলমান বিক্ষোভের ব্যাপারে দেয়া বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, বাংলাদেশের নারীরা ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বন্ধ করতে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে যথেচ্ছভাবে দায়ী করতে পারে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত শুধু প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে বিক্ষোভকারীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যৌন সহিংসতা বন্ধে ও ধর্ষণের শিকার নারীদের সমর্থনের ব্যাপারে অর্থপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

চলছে বিক্ষোভ–সমাবেশ

শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সরকারের নেতা–কর্মীরা সারা দেশে নারী-শিশু ধর্ষণের সাথে যুক্ত। তারা ধর্ষণ করে ‘বুক ফুলিয়ে’ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গত কয়েক দিনের ধারাবাহিতকায় সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৯ দফা দাবি উঠেছে শাহবাগের মহাসমাবেশ থেকে।

সাধারণ শিক্ষার্থী, বামধারার ছাত্র সংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা শুক্রবার বিকেলে মহাসমাবেশ থেকে বিক্ষোভ করেন। সেখানে জানানো হয়, প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত পর্যন্ত শাহবাগে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলবে।

এদিকে সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তাঁর সমর্থকরা। এতে যোগ দেন নাগরিক ঐকের প্রধান ও সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না।

শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর সম্মিলিত ইসলামী দল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ বের করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।