অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ: কুপিয়ে সাংবাদিক হত্যা
2020.10.12
ঢাকা

বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ইলিয়াস শেখ (৪৫) নামে এক সাংবাদিককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশ জানিয়েছে, রোববার রাত আটটার দিকে বন্দর উপজেলার আদমপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইলিয়াস নারায়ণঞ্জের স্থানীয় দৈনিক বিজয় পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন।
পত্রিকার সম্পাদক ও পুলিশের ভাষ্যমতে, পেশাগত দায়িত্বে পালনের কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিরোধীদল সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন অভিযোগ করেছে, “বিচারহীনতার কারণে দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুন, নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটছে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমান সরকারের ১১ বছরে ৪০ জনের মতো সাংবাদিক খুনের শিকার হয়েছেন। কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, খুন, হয়রানি, নির্যাতন ও হুমকির পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মক হুমকির মুখে।
‘সাংবাদিকতার কারণেই হত্যা’
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বেনারকে বলেন, রবিবার রাত আটটার দিকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বন্দর উপজেলার আদমপুর এলাকায় ইলিয়াসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। মারাত্মক আহত ইলিয়াসকে উদ্ধার করে নারায়নগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় স্থানীয়রা।
হাসপাতালে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা।
পুলিশ সুপার বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মামলা দায়ের করেছেন ইলিয়াসের স্ত্রী। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত মূল আসামী তুষারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
জায়েদুল আলম বলেন, “তাঁকে কেন হত্যা করা হলো তা তদন্তাধীন। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি বন্দরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ সিন্ডিকেট তাঁকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। ইলিয়াস ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংবাদ লিখেছিলেন।”
দৈনিক বিজয় পত্রিকার সম্পাদক সাব্বির সেন্টু বেনারকে বলেন, “সাংবাদিক ইলিয়াস বন্দর এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ সিন্ডিকেট, ইয়াবা ব্যবসায়ী ও জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে প্রায়ই সংবাদ লিখতেন। এগুলো নিয়ে এলাকার প্রভাবশালী মাস্তানরা তাঁকে হুমকি দিতো।”
তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে তুষার বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম তিনি যেন নারায়ণগঞ্জের অন্য এলাকায় গিয়ে সাংবাদিকতা করেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।”
সেন্টু বলেন, “সাংবাদিকতার কারণেই ইলিয়াসকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে হত্যা, নির্যাতন, হামলা ও হুমকিসহ সাংবাদিক হয়রানির ২০৯টি ঘটনা ঘটেছে। সংগঠনটির মতে, সংবাদ প্রকাশের কারণে ৮১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা হয়েছে।
ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে কারাগারে
নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেয়া পোস্টে প্রধানমন্ত্রী শব্দের পর একটি কমা না দেয়ায় রাজবাড়ী জেলার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম খন্দকারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল ইসলাম মন্ডল।
রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বপন কুমার মজুমদার বেনারকে বলেন, “শনিবার মামলা হওয়ার পর আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছি। আদালত তাঁর জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
কমা না দেয়ার অপরাধে মামলা নেয়া হলো কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, “উনি বলেছেন উনি ভুল করে প্রধানমন্ত্রী শব্দের পরে কমা দেননি। কিন্তু উনি কি ইচ্ছা করে কমা দিতে ভুলে গেলেন কি না সেটিও তদন্তের বিষয়। আমরা তদন্ত করে দেখছি।”
ফেসবুক পোস্ট: আদালতে নিষিদ্ধ আইনজীবী
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে আপত্তিকর পোস্ট দেয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দকে সোমবার থেকে তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ করেছে আপিল বিভাগ। বেনারকে এ কথা জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।
তিনি বলেন, সোমবার আপিল বিভাগ স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে নিষিদ্ধের পাশাপাশি ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
ইউনুছ আলী আকন্দ বেনারকে বলেন, “আমি কী লিখেছি ভুলে গেছি। আমি ফেসবুকে লিখি আর মুছি। জানি না কি লিখেছিলাম।”
মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে
আইনজীবী হাসনাত কাইয়ূম বেনারকে বলেন, “স্বাধীনতার মূল কথা হলো, মত প্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা। এগুলো আমাদের সাংবিধানিক গ্যারান্টি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা একজন মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মক হুমকির মুখে।”
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইন মানুষকে চিন্তা করতে দেবে না, বলতে দেবে না। আমার ভাবতেও অবাক লাগে বাংলাদেশে এমন একটি আইন থাকে কীভাবে?”
কাইয়ূম বলেন, “যতদ্রুত সম্ভব ডিজিটাল নিরাপত্তা নামক এই কালো আইনটি বাতিল করা যায় ততই তা দেশের জন্য মঙ্গল।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে কোন পর্যায়ে গেছে তা বলা কঠিন। শুধু সাংবাদিকরা নয়, দেশের প্রত্যেক মানুষ এই আইনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজবাড়ী জেলায় একজন মানুষ তাঁর ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর নামের পর একটি কমা না দেয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে এবং তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এটি কেমন কথা হলো? আমার আসলে বলার ভাষা নেই।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশের দুবছর উপলক্ষে ৮ অক্টোবর দেয়া এক বিবৃতিতে ইউরোপ ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার্স জানিয়েছে, গত দুবছরে এই আইনে কমপক্ষে ২০৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০৪ জন। আর এই মামলার অধিকাংশই ২০২০ সালে রুজু করা হয়েছে।