কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ: একমাত্র আসামির যাবজ্জীবন

জেসমিন পাপড়ি
2020.11.19
ঢাকা
201119_DU_student_Rape_Verdict_1000.jpg কুর্মিটোলায় সহপাঠী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ। ৭ জানুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে কুর্মিটোলায় ব্যস্ত সড়ক থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি মো. মজনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

বৃহস্পতিবার ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাদীপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বেনারকে জানান, যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আসামিকে আরও ছয় মাস জেল খাটতে হবে।

তিনি জানান, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আগে এই মামলার অভিযোগ গঠন হয়। আসামি মজনুকে পূর্বের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী।

আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বেনারকে বলেন, “বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই এই মামলায় রায় হওয়ায় এই রায়কে সাধুবাদ জানাই। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়েছিল। রায়ে সেটাই হয়েছে। এটা একটা ভালো বার্তা।”

আসামি মজনুর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইডের রবিউল ইসলাম রবিকে এ মামলায় মজনুর পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আসামি ন্যয়বিচার পাননি। তিনি চাইলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন।”

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ের আগে আসামি মজনুকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ১৯ নভেম্বর ২০২০।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ের আগে আসামি মজনুকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ১৯ নভেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

আদালতে মজনুর অস্বাভাবিক আচরণ

আদালতে আসামি মজনু অস্বাভাবিক আচরণ করেন। এসময় তিনি পুলিশের এক সদস্যের শার্টের কলার ধরে টান দেওয়া, আত্মহত্যার হুমকি দেওয়াসহ পুলিশ ও উপস্থিত ব্যক্তিদের গালিগালাজ করতে থাকেন।

রায়ের আগে মজনুর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করলে তাঁর আইনজীবী রবি বলেন, “সে নেচারালি এরকম। আজ অনেক লোক যখন প্রশ্ন করেছে, সে ধর্ষণ করেছে কি না সেই সুযোগ সে উল্টো পাল্টা আচরণ করেছে, অস্বাভাবিক আচরণ করেছে।”

বাদীপক্ষের আইনজীবী জানান, আদালত প্রাঙ্গণে অনেক মানুষ, সাংবাদিক, ক্যামেরা দেখে মজনু কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। পরে এজলাসেও একই আচরণ করতে থাকেন। এসময় আদালত তাঁকে শান্ত করতে সাংবাদিকসহ অধিকাংশ মানুষকে বের করে দিয়ে রায় পড়ে শোনান।

মামলার বিচার চলাকালীন বিভিন্ন সময়েও মজনু এ ধরনের উগ্র আচরণ করেছিলেন বলে সাংবাদিকদের জানান তাঁর পক্ষের আইনজীবী রবিউল ইসলাম।

গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর ঢাকার কুর্মিটোলায় নির্জন সড়কের পাশে ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী। পরদিন ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন তাঁর বাবা।

ওই ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে ধর্ষকের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। পরে দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি ওঠে।

তারই প্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন সংশোধনের পদক্ষেপ নেয় সরকার।

ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনার তিন দিন পর মজনুকে (৩০) গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‌্যাব। পরে র‍্যাব জানায়, আটকের পর মজনুর ছবি ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর কাছে পাঠালে তিনি তাঁকে শনাক্ত করেন।

তদন্ত শেষে গত ১৬ মার্চ শুধুমাত্র মজনুকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দা‌খিল ক‌রে পুলিশ। আদালত গত ২৬ আগস্ট ভার্চুয়ালি শুনানিতে মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেননি।

সংসদে বিল পাস: ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

এদিকে এই রায়ের মাত্র দুদিন আগে মঙ্গলবার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’ পাস হয়েছে।

আইনের এই সংশোধনীতে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটির বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দবন্ধ বসানো হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে সেটি পাস হয়।

নতুন আইনে অপরাধের শিকার ব্যক্তির পাশাপাশি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির মেডিক্যাল পরীক্ষা করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ।

তবে ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করলেই ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা যাবে না বলে মনে করেন আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী। তাঁর মতে এর জন্য “ধর্ষণ আইনে অনেক বড় সংস্কার দরকার।”

তিনি বলেন, “ধর্ষণ আইনের সাথে স্বাক্ষ্য আইন, বাংলাদেশ পেনাল কোড, যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞার মতো বিষয়ে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সেসব জায়গায়ও সংশোধনী আনতে হবে।”

“পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ, সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করাসহ সার্বিক যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হলেই সুফল পাওয়া যাবে,” বলেন নীনা গোস্বামী।

এদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজনুর বিচারের রায় হওয়াকে ‘একটা দৃষ্টান্ত” হিসেবে উল্লেখ করেন উন্নয়নকর্মী ফেরদৌস আরা রুমি।

তবে তাঁর মতে, “সমাজের বেশির ভাগ ধর্ষক ক্ষমতাবান। এ কারণে আইনের ফাঁক-ফোঁকর পেরিয়ে তারা বের হয়ে যায়। বলতে গেলে প্রভাবশালী ধর্ষকদের বিচার হয় না।”

তিনি বলেন, “মজনুর বিচারকে দৃষ্টান্ত ধরে সকল ধর্ষণের বিচার দ্রুততম সময়ে করতে হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। তাহলেই পরিস্থিতি বদলাতে পারে। অন্যথায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেও ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব হবে না।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার তিনশ ৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৭৭ জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।