সাত ঘণ্টায় চার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৬

শরীফ খিয়াম
2019.03.27
ঢাকা
190327_Gunfight_1000.JPG ঢাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত কামরুলের লাশের ছবি মোবাইল ফোন থেকে দেখাচ্ছেন তাঁর এক আত্মীয়। ২৬ মে ২০১৮।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

মাত্র সাত ঘণ্টায় ঢাকাসহ তিন জেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত চারটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বুধবার ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কক্সবাজারের দুটি ঘটনায় দুই রোহিঙ্গাসহ নিহতের সংখ্যা চার।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে চলা ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে “সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না,” বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এই ধরনের হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৪জন।

“মাদক বিরোধী যুদ্ধ ও সন্ত্রাস নির্মূলের নামে মানুষকে গত কয়েক বছর ধরে একটানা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মুখোমুখি করা হচ্ছে,” মন্তব্য করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে, কিন্তু সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না।”

তবে “আমাদের দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে না,” দাবি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন বেনারকে বলেন, “এখানে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়।”

এদিকে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তিনশ'র বেশি ঘটনার অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন, “প্রতিটি বিচার বা আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া উচিত। এটাই আইনের বিধান। সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা এবং দাবি।”

সরকার কখনো আমাদের কথা রাখেন, কখনো রাখেন না, উল্লেখ করে তিনি জানান, বিচার ও আইন বহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে কমিশন ভবিষ্যতেও সোচ্চার থাকবে।

এদিকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮৪ জন।

ঢাকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য মতে, মার্চের ২৭ তারিখ পর্যন্ত এভাবে মারা গেছেন কমপক্ষে ৩০ জন। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে মোট ৫৪ জন একইভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।

যার মধ্যে ১৫ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক থাকা অবস্থায় ‘গুলিবিদ্ধ’ হয়েছেন বলেও উল্লেখ রয়েছে আসক এর প্রতিবেদনে।

তবে “আত্মরক্ষার খাতিরেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছোড়ে” বলে গত ৯ মার্চ ঢাকায় এক মাদক বিরোধী সমাবেশে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি দক্ষিণ আমেরিকান দেশ ও ফিলিপাইনের মাদক বিরোধী অভিযানের উদাহরণও তুলে ধরেন।

পরদিনই তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে আসক জানায়, মন্ত্রী যেসব দেশের মাদকবিরোধী অভিযানের দৃষ্টান্ত সামনে এনেছেন সেগুলো সারা বিশ্বেই মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত।

সংস্থাটি বলেছে, “আমরা ক্রসফায়ারে নয়, ঠান্ডা মাথায় কাউন্সিলর একরামুল হকের মৃত্যুর অডিও রেকর্ড শুনেছি, যে ঘটনার তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না।”

প্রসঙ্গত, গত বছরের মাদক বিরোধী যুদ্ধ শুরুর পরপরই ২৬ মে দিবাগত রাতে টেকনাফ যুবলীগের সভাপতি একরাম র‍্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর অন্তিম ফোনালাপের অডিও প্রকাশ করেন।

ওই ঘটনার পর মাদক বিরোধী যুদ্ধ নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও অবস্থান পরিবর্তন করেনি সরকার। তবে “একরাম ‘এনকাউন্টারে’ মারা গেছে। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়,” বলে দাবি করেন জননিরাপত্তা সচিব।

চার বন্দুকযুদ্ধেনিহত ছয়জন

মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত মাত্র সাত ঘণ্টায় ঢাকাসহ তিন জেলায় কথিত চারটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছয়জন নিহত হয়েছেন। এর মাঝে কক্সবাজারে চার এবং ঢাকা ও গাজীপুরে একজন করে নিহত হন।

সব ক্ষেত্রেই ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি ছোড়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার খারাংখালী এলাকায় বুধবার ভোর রাত সাড়ে চারটার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন রোহিঙ্গা নিহত হন বলে বেনারকে জানান বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার।

নিহত দুজনই ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা। এরা হলেন মিয়ানমারের জিবিংচংওয়ার মোহাম্মদ ইদ্রিসের ছেলে মোহাম্মদ ফারুক মিয়া (১৯), ও একই এলাকার মোহাম্মদ আবু তাহেরের ছেলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (১৮)। এরা “দুজনই ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন” বলে বেনারকে জানান মেজর শরীফুল।

এর আগে মঙ্গলবার ভোরে মোহাম্মদ সাদেক নামে এক রোহিঙ্গার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, টেকনাফ নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের ওই বাসিন্দা পেশায় ডাকাত ছিলেন।

বুধবার ভোর পাঁচটার দিকে একই জেলার পেকুয়া উপজেলার মগনামা ঘাট এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন ‘জলদস্যু’ নিহত হন বলে বেনারকে জানান র‍্যাব-১৫’র কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসান। তবে নিহতদের নাম পরিচয় এখনো জানা যায়নি বলে বেনারকে জানান পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন ভুঁইয়া।

এদিকে ঢাকার মিরপুরের ভাষানটেক এলাকায় মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে র‍্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নরসিংদী জেলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত এক শীর্ষ সন্ত্রাসী শফিক নিহত হন বলে সাংবাদিকদের জানান র‍্যাব-১১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী শামসের উদ্দিন।

“গুলিবিদ্ধকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলিসহ তাঁর দুই সহযোগীকে আটক করা গেছে,” বলেন তিনি।

একই রাতে গাজীপুরের এরশাদনগর এলাকায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ কাওসার (২৫) নামের ছিনতাইকারী সকাল সাতটার দিকে হাসপাতালে মারা যান।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “কাওসারকে আটকের পর বিষয়টি টের পেয়ে তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে তাদের গুলিতেই সে আহত হয়।”


উল্লেখ্য, চলতি মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কক্সবাজার জেলায় সর্বোচ্চ ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ঢাকায় তিনজন এবং মেহেরপুরে ও চুয়াডাঙ্গায় দুজন করে এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, খুলনা, যশোর, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুরে একজন করে মারা গেছেন।

আসক’র সাবেক নির্বাহী লিটনের অভিমত, এটা বিচার বিভাগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল। এই মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, “সাধারণ মানুষ হতভম্ভ, একটা ভয়ার্ত পরিবেশ বিরাজ করছে সমাজে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও কেউ প্রতিবাদ করছে না।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন টেকনাফ থেকে আবদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।