অস্তিত্ব সংকটে আইন ও সালিশ কেন্দ্র
2017.01.09

অসহায়কে আইন ও মানবিক সহায়তা দেওয়া দেশের সবচেয়ে সুপরিচিত মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আসক-এর প্রধান দাতা সংস্থা বাংলাদেশে সব ধরনের অনুদান বন্ধ করে দেওয়ায় সস্থাটি এই সংকটে পড়েছে। এর দুই তৃতীয়াংশ কর্মীকে বছরের শেষ কর্মদিবস ২৯ ডিসেম্বর বিদায় দেওয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কেন্দ্রটির অনেকগুলো ইউনিট।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আসক বন্ধ হয়ে গেলে মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি শক্তিশালী কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাবে, যা চূড়ান্তভাবে বিপুলসংখ্যক অসহায় নারী, শিশু ও সংটাপন্ন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
“মূলত: অর্থ সংকটের কারণে সংগঠনটি এই অবস্থায় পড়েছে। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো তহবিল দিচ্ছে না,” বেনার নিউজকে জানিয়েছেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন।
আসক সূত্র জানায়, জনস্বার্থে হাইকোর্টে অর্ধশতাধিক রিট মামলার আবেদনকারী আইন ও সালিশ কেন্দ্র। জনগুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক আবেদনময় বেশ কিছু মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। অথচ হাইকোর্টে রিট মামলা দেখার জন্য আসকের যে পিআইএল (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) ইউনিট সেটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
নরওয়ের উন্নয়ন সংস্থা-নোরাডের কাছ থেকে ৪২ শতাংশ অনুদান পেত আসক। বছর দুয়েক আগে তারা বাংলাদেশের সব অনুদান বন্ধ করে দেয়। সবচেয়ে বড় অনুদান বন্ধের পর আসক এ ধরনের বড় দাতা আর খুঁজে পায়নি। এখন কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার ছোট ছোট অনুদান রয়েছে। এর মধ্যে আছে সুইজারল্যান্ডের এসবিসি, ডেনমার্কের ডানিডা, কানাডার সিডা, জার্মানির নেট বাংলাদেশ এবং সেভ দা চিলড্রেন। আসক সূত্র জানায়, এসব ছোট ছোট প্রকল্প বা অনুদান দিয়ে এত বড় মানবাধিকার সংস্থার কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
যেসব আলোচিত মামলা ও কর্মসূচি বিপন্ন
নিজের নিরাপত্তা সংকট তুলে ধরে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর নাম জড়িয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে। ব্যাপক গণ অসন্তোষ ও বিক্ষোভের মুখে সরকার তাকে দু’দিন পর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু দায়েরকৃত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি এখনো আছে। প্রবীর শিকদারকে আইন সহায়তা দিয়ে আসছে আসক।
এ প্রসঙ্গে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রবীর শিকদার বেনারকে বলেন, “আশা করি আইন ও সালিশ কেন্দ্র এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই আসকের পাশে দাঁড়াবে।”
নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে জনসমক্ষে হেনস্তা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এবং কল্যাণপুর বস্তি উচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত রিটসহ আসকের অনেক মামলায় গণমানুষের আবেগ ও আন্দোলন জড়িত। মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
দেখভালের অভাবে মামলাগুলো খারিজ হয়ে গেলে দেশ ও মানুষের ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। আসকের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র আইনজীবী মাহজাবীন রব্বানী দীপা বলেন, “এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ও আইনি ব্যাখ্যা থেকে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হবে।
আসকের চারটি লিগ্যাল এইড ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকার জজ কোর্টেই অন্তত: সাড়ে আটশ’ মামলা ঝুলে আছে। আসকের লিটিগেশন ইউনিট এই মামলাগুলো পরিচালনা করত। এই ইউনিটে বর্তমানে আইনজীবী আছেন মাত্র দু’জন। রাজধানীর বাইরেও এ রকম অনেক মামলা ঝুলে আছে। নির্যাতিত অসহায় শিশু এবং নারী ভিকটিমদের পক্ষে আসক এসব মামলা পরিচালনা করত বলে বেনার নিউজকে জানান অ্যাডভোকেট স্নীগ্ধা সাহা।
রাজধানীতে বস্তিবাসী, সুবিধা বঞ্চিত ও পথ শিশুদের জন্য আসক পরিচালিত “যখন-তখন” স্কুলগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব স্কুলে শিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি এক বেলা খাবার এবং চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হতো। স্কুলগুলোর সমন্বয়ক হিসেবে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন নার্গিস আখতার। সম্প্রতি তাকেও প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। ছয়টি স্কুলের মধ্যে চারটি স্কুল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বলে তিনি বেনার নিউজকে জানান।
সালিশি বৈঠক ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবার (কাউন্সেলিং) মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ ও দাম্পত্য কলহ নিরসন করা আসকের অন্যতম প্রধান কাজ। আসকের আইনজীবীরা বিবদমান পক্ষগুলোকে ডেকে সালিস মীমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতেন।
ওই ইউনিটের সাবেক আইনজীবী কুহেলি সুলতানা বেনার নিউজকে বলেছেন, “বছরে কম পক্ষে ১২ হাজার পারিবারিক বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির টার্গেট নিয়ে আমরা কাজ করেছি। সফলতার হার ছিল ৮০ শতাংশ।”
অনেকের মতো কুহেলি সুলতানাও ২৯ তারিখ সংগঠনটি থেকে বিদায় নিয়েছেন। ওই ইউনিটে এখনো ২৪ শ’ বিরোধ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আসক সূত্র জানায়, ওই ইউনিটে ১২ জন আইনজীবীর মধ্যে চারজনকে রাখা হয়েছে। লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও পলিসি রিফর্ম ইউনিট, পিআইএল ইউনিট, কাউন্সেলিং ইউনিট এবং আউটরিচ ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
এখনো কিছু আশাবাদ
“আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রায় ২৯ কোটি টাকার একটা তহবিল পাওয়ার আশা করছি। এটা পেলে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে পারব। না পেলে কী হবে তা জানি না,” বলেছেন নূর খান লিটন।
তহবিল সংকটের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এটা গ্লোবাল ফেনোমেনা, অভ্যন্তরীণ নয়। এখন দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো আগের মতো ফান্ড দিচ্ছে না।”
আসকের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নির্বাহী কমিটিতে আছেন বিশিষ্ট আইনজীবী জেড আই খান পান্না। বেনার নিউজকে তিনি বলেছেন, “সংকট তৈরি হলেও সমাধানের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। ২০০৮ সালে এর চেয়ে বড় ক্রাইসিস হয়েছিল ব্লাস্টের ক্ষেত্রে। সেই সংগঠন এখন আগের চেয়েও ভালো করছে।”