আবারও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হত্যা, বিক্ষোভওবিচার দাবি
2016.04.07

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ঢাকার সরকারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
নাজিমের বন্ধুদের সন্দেহ হচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীরা তাঁকে হত্যা করেছে। পুলিশ বলছে, তদন্তের পর তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করবে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পেন ইন্টারন্যাশনাল, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবের ধারণা, ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে নাজিম জঙ্গিবাদ, ধর্ম ও সরকারের সমালোচনা করেছেন। এই লেখালেখির কারণেই তাকে খুন করা হতে পারে।
তবে এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। পুলিশও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
“হত্যার ধরন থেকে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে,” বেনারকে জানান সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন কুমার সাহা।
২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ছয়জন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু ব্লগাররাই নয়, খুন ও হামলার শিকার হচ্ছেন প্রকাশকেরাও। প্রতিবার একইভাবে কোপানো ঘটেছে। কিন্তু এসব ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও বিচার হয়নি।
“অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার এক নতুন মডেল দেখতে পাচ্ছি। প্রতিটি খুনের পর বলা হচ্ছে অপরাধীরা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে পালিয়ে গেছে। একটা সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দিকে দেখিয়ে আসল ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে,” বেনারকে জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। ধর্মীয় স্লোগানের কথা তুলে দুইটি পক্ষ তৈরি করা হচ্ছে, একপক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপে ব্যস্ত থাকছে, আর এই ফাঁকে অপরাধীদের আর বিচার হচ্ছে না।
গত বুধবার রাত নয়টার দিকে বাসায় ফেরার সময় সূত্রাপুরের একরামপুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে নাজিমকে হত্যা করা হয়। মোটরসাইকেল আরোহীরা পথ রোধ করে তাঁর ওপর এই হামলা চালায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন শিফটের ছাত্র ছিলেন।
নাজিমের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি কারি সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নুরুল ইসলাম বলেন, মাথায় কুপিয়ে ও গুলি করে নাজিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়।
ফেসবুক পাতায় নাজিম উগ্রবাদীদের কড়া সমালোচনা করে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী নন। সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েও বিচার দাবি করেছেন তিনি।
নাজিম উদ্দিন কোনো ব্লগ সাইটে লেখালেখি করতেন না। তার লেখালেখি ছিল মূলত ফেসবুকে। ২৮ মার্চ একটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছিলেন, “রাষ্ট্রধর্ম দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার ইসলামি জঙ্গি হাসে।” মৃত্যুর একদিন আগেও নাজিম উদ্দিন ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইন-শৃঙ্খলার যা অবনতি তাতে গদিতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না।–––
নাজিম সিলেট জেলা বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চের সিলেটের সংগঠক হিসেবে তিনি কাজ করেছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়িও সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ইউনিয়নের টুকাভড়াউট গ্রামে।
পাঁচ ভাই ও দুই বোনের পরিবারে নাজিম চতুর্থ। বড় ভাই জুলহাস উদ্দিন ও বাবা আবদুস সামাদ মারা গেছেন। শামীম উদ্দিন নামে তাঁর এক বড় ভাই ও ছোট ভাই জসিম উদ্দিন থাকেন লন্ডনে। আর মেজ ভাই সুনাম উদ্দিন ফ্রান্সের বাসিন্দা। গ্রামের বাড়িতে ছোট বোন নাছিমা বেগমকে নিয়ে মা তহিরুন্নেছা (৬০) থাকেন।
বিক্ষোভে উত্তাল জগন্নাথ
অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় প্রায় চার ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে।
শিক্ষার্থীরা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছে। সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে আগুন জ্বালিয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। ফলে গুলিস্তান থেকে সদরঘাটমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
“এভাবে নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা আর মেনে নেওয়া যায় না। একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষ খুন হবে—সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চুপ থাকবে, এটা লজ্জার ও দুঃখের,” বেনারকে জানান বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা।
নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ।
“আগামীকাল শুক্রবার বিকাল ৩টায় শাহবাগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। শনিবারের মধ্যে খুনিরা গ্রেপ্তার না হলে রোববার সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হবে,” বেনারকে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এস কে শুভ।
নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ এবং ইইউ
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনস বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট হত্যায় কিছুদিন ছেদ দেখা গেলেও এই হামলায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার অংশ হিসেবেই নতুন এ হত্যাকাণ্ড।”
তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ প্রতিনিধি।
রবার্ট ওয়াটকিনস তার বিবৃতিতে বলেন, তিন বছর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড শুরুর পর থেকে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ঝুঁকির মুখে থাকা অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত’ করতে আবারও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘ প্রতিনিধি।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন পৃথক বিবৃতিতে বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক মানবাধিকার। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহিষ্ণুতার চর্চার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়েই দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। কারণ এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তি।
পিয়েরে মায়াদুন আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার যে কোনো উদ্যোগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থন পাবে।
তিনি নাজিমের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং তদন্তের মাধ্যমে খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
হত্যার দায় সরকারের: ইমরান এইচ সরকার
নাজিমুদ্দিন হত্যার প্রতিবাদে গতকাল শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মশাল মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চ।
মঞ্চের কর্মী সনাতন উল্লাসের সঞ্চালনায় সমাবেশে সহযোদ্ধার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বক্তারা। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
শুক্রবার বিকাল চারটায় নাজিমুদ্দিন হত্যাসহ একের পর এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শাহবাগে সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
“নাজিমুদ্দিন সামাদ সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যে স্বপ্ন নিয়ে কিছুদিন আগে ঢাকায় এসেছিলেন, চাপাতির আঘাতে, পিস্তলের গুলিতে সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে,” বলেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
তিনি বলেন, শুধু সামাদই নন, কিছুদিন আগে খুন হয়েছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার যাজক। একটির পর একটি ঘটনা ঘটে চলছে। সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদে যখন সারা দেশের মানুষ সোচ্চার, তখনই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আগের খুন-ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো বলে মত দেন ইমরান।
“বিচারহীনতার কালো থাবা থেকে দেশকে মুক্ত করতে, নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে,” বলেন গণজাগরণ মঞ্চের নেতা বাকি বিল্লাহ।
ব্লগার হত্যার তদন্ত ও বিচারে ধীরগতি
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় হলেও আরও পাঁচজন ব্লগার-প্রকাশক হত্যা মামলাগুলোর তদন্তই এখনো শেষ হয়নি।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় করা মামলার রায়ে দুজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ, একজনকে যাবজ্জীবন এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
ব্লগার-প্রকাশক-মুক্তমনা লেখকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় করা মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম রায়। বাকি মামলাগুলোর মধ্যে ঢাকায় ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিন হত্যাচেষ্টা এবং ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান হত্যা মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্লগার অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন হত্যা মামলাগুলোর তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় দুর্বৃত্তরা লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদকে গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবি ওই মামলায় এ পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে রাস্তার ওপর ব্লগার ওয়াশিকুরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জনতা খুনিদের ধাওয়া করে এবং একজন হিজড়া দুজনকে ধরে ফেলেন। এঁরা হলেন জিকরুল্লাহ ওরফে হাসান ও আরিফুল ইসলাম। এ মামলায় এ দুজনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ডিবি ১ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
১২ মে সিলেটের সুবিদ বাজারে খুন হন বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। গত বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানে নিজ বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয়কে। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় করা মামলায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
৩১ অক্টোবর শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা প্রকাশক ও জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিনকে। একইদিন লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ ও দুই লেখক-ব্লগারকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ দুই ঘটনায় করা দুটি মামলাও তদন্ত করছে ডিবি। তবে কোনো মামলার তদন্তে এখনো তেমন অগ্রগতি নেই।