রেড জোনে ৯ ব্যাংক : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

আহম্মদ ফয়েজ
2024.03.11
ঢাকা
রেড জোনে ৯ ব্যাংক : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন । ১১ মার্চ ২০২৪
[সুদীপ্ত সালাম/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব তিনটি ব্যাংকসহ নয়টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর হওয়ার চিত্র ফুটে ওঠার প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যাংকের অনুমোদন, ঋণখেলাপি হওয়াসহ রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।

এই প্রেক্ষাপটে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একাীভূত করার উপায় খুঁজছে।  বিদ্যমান ৬১ ব্যাংক কমিয়ে কতটি রাখা হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত না হলেও যেসব ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে, তাদের দিকেই প্রথম ধাপে নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা।

ডিসেম্বর ২০২০ থেকে জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫৪টি ব্যাংকের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে, যেখানে ব্যাংক খাতের দূরাবস্থা ফুটে উঠেছে।  প্রতিবেদনটি বেনারের হাতে এসেছে।

প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে বলেন, “এটি কোনও পাবলিক প্রতিবেদন নয়।  এটি করা হয়েছে আভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা মূল্যায়নের জন্য।  সে কারণে এই প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য গণমাধ্যমে দেয়া যাচ্ছে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদন এমন সময় আলোচনায় এসেছে যখন দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে চেষ্টা শুরু করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।

একীভূত করা প্রসঙ্গে মেজবাউল বলেন, “একীভূত করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে ব্যাংক খাতের মঙ্গলের জন্যই। এটি পরীক্ষা-নিরিক্ষা পর্যায়ে রয়েছে।”

 

যা আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনের “ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স এবং হিট ম্যাপ” অনুসারে দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে; এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। এই তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংকের নাম এসেছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২৯ টির মতো ব্যাংক ইয়েলো জোনে রয়েছে, যার অর্থ এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো এবং খারাপের মধ্যে রয়েছে।

মূলধনের পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণমান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন, তারল্য এবং বাজারের ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতার আলোকে এই মূল্যায়ন করা হয়।

রেটিং পয়েন্ট ১ হলে সেরা হিসাবে বিবেচিত হয় এবং এই পয়েন্ট ৫ হয়ে গেলে সবচেয়ে খারাপ হিসাবে বিবেচিত হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেড এবং ইয়োলো জোনের ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধানে আরো মনোযোগ প্রয়োজন।

ইয়েলো জোনে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের নাম রয়েছে। অপরদিকে এই তালিকায় ১৮টি প্রচলিত বেসরকারি ব্যাংক এবং আটটি শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিন জোনে ১৬টি ব্যাংক রয়েছে। যার মানে হচ্ছে এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো।

অন্যদিকে, ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবে সাম্প্রতিক সময়ে অনুমোদন পাওয়া চারটি ব্যাংককে এই নিরিক্ষার জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট–বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর দায়বদ্ধতার অভাব বাংলাদেশের ‘অর্থনীতির সমার্থক’ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মাসুদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ কীভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা রাখবে।

দ্য ডেইলি স্টারের  গত বছরের ৪ আগস্ট প্রকাশিত ‘এস আলমের আলাদিনের চেরাগ’ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে কমপক্ষে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।  যদিও বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তিনি নেননি।  এস আলম গ্রুপ খবরের প্রতিবাদ জানালেও ডেইলি স্টার জানায়, তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সঠিক, তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ।
এ ছাড়া ফারমার্স ব্যাংক (পরবর্তীতে পদ্মা ব্যাংক), বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংকসহ এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকের শত শত কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানিয়ে দেন।  এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমকে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অর্থনীতির আকারের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে- অর্থনীতিবিদদের এমন দাবি অনেক দিনের। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও মনে করছে, এ সংখ্যা কমানোর দরকার।  দুর্বল ব্যাংকগুলো এখন দেশের পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা হয়ে ওঠায় একীভূতকরণ বা মার্জারের বিষয়টি আর্থিক খাতের সংস্কারের আলোচনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

ব্যাংকিং খাত হুমকিতে ফেলেছে রাজনৈতিক প্রভাব: বিশেষজ্ঞ

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ১৫ বছরে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অনেকগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে, এই ব্যাংকগুলো ব্যাংক খাতকে সামগ্রিকভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে।

“ব্যাংক খাতের এই সংকট কিন্তু কোন ভুলে বা অবহেলায় হয়নি। এটির পেছনে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি জড়িত। এই পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ থেকে শুরু করে সকল প্রক্রিয়ায় যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়েছে এবং নিজেদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে যেভাবে সুবিধা দিয়েছে তাতে এই পরিস্থিতি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।

‘তিনি বলেন, “বড় বড় কিছু ঋণ খেলাপি তৈরি হয়েছে, ব্যাংকগুলো লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া অর্থ পাচারের মহোৎসবে মেতেছেন কিছু মানুষ।”

দুর্বল ব্যাংকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “এই চিন্তাটি এখনো বাস্তবসম্মত কোনও চিন্তা নয়। দুর্বল ব্যাংকের দায়ভার কেন সবল ব্যাংক নিতে যাবে।  আবার দুটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে পরিস্থিতি কি হবে?”

তিনি বলেন, “অবস্থাটা এমন হয়েছে যে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে যেসব মূল্যায়ন তৈরি হচ্ছে সেটা দেখেও সঠিক চিত্র পাওয়া কঠিন, কারণ সেখানেও প্রকৃত অবস্থা গোপন করা হয়।  তাই এসব সাময়িক সমাধানের পথ না খুঁজে সমস্যার মূল চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সরকার লাগামহীনভাবে ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে এখন সেগুলোকে নিজেদের গলার কাঁটায় পরিণত করে ফেলেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।