কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশে বাধা: সংবাদ সম্মেলন বর্জন সাংবাদিকদের
2024.05.08
ঢাকা

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করার প্রতিবাদে বুধবার ব্যাংক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন জোটবদ্ধ হয়ে বর্জন করেছেন সাংবাদিকরা, যা অনেকটা নজিরবিহীন।
এদিন সংবাদ সম্মেলন বর্জন করার পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকে অবস্থান নিয়ে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ জানান।
সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের পর গত মাসের শেষ দিকে ঢাকার মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ফটকে বিক্ষোভ করেছিলেন ব্যাংকিং খাত নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা।
সে সময় বেনারের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বেনারকে বলেছিলেন, “৮ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি কর্মশালা হতে পারে এবং সেখান থেকেই সমস্যার একটি সমাধান বের হয়ে আসতে পারে।”
তবে বুধবার সাংবাদিকদের প্রতিবাদের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি এই কর্মকর্তা।
সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে প্রতিবাদ
পূর্ব নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে বুধবার সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়েছিলেন। ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান ও অন্যান্য কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতেই সাংবাদিকরা জানতে চান, সাংবাদিকদের প্রবেশের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে?
দৈনিক ভোরের কাগজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মরিয়ম সেঁজুতি বেনারকে বলেন, “কর্মকর্তারা আমাদের জানান, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এবং তা পরে গভর্নরকে অবহিত করা হবে। তখন সাংবাদিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করে একযোগে সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে নিচে নেমে আসেন।”
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে ব্যাংকের প্রধান ফটকে প্রতিবাদে সাংবাদিকরা অবস্থান করেন।
প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সাংবাদিকদের পক্ষে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল। বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এক মাস আগে হঠাৎ সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের পেশাগত কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এতে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহীত নীতি ও কার্যক্রম নির্ভর সংবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিত প্রতিবাদ করার পর আমাদের জানানো হয়েছিল, ৮ মের পর সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”
সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের খবর বর্জন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “নতুন কর্মসূচি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করে জানানো হবে।”
সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা যে কারণে
মূলত মার্চ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স এবং হিট ম্যাপ’ প্রতিবেদনের একটি অংশ প্রকাশ পায়। সেখানে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটিসহ নয়টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর।
বেনারসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫৪টি ব্যাংকের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করে; যেখানে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা প্রকাশ পায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক রেড জোনে রয়েছে।
প্রতিবেদন আরও উল্লেখ করা হয়, ২৯টির মতো ব্যাংক ইয়েলো জোনে রয়েছে। যার অর্থ হলো, এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো এবং খারাপের মধ্যে রয়েছে।
মূলধনের পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণমান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন, তারল্য ও বাজারের ঝুঁকির ওপর সংবেদনশীলতার আলোকে এই মূল্যায়ন করা হয়।
প্রসঙ্গত, রেটিং পয়েন্ট এক হলে সেরা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই পয়েন্ট পাঁচ হয়ে গেলে সবচেয়ে খারাপ হিসেবে বিবেচিত হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখ্য, রেডজোনে থাকা পদ্মা ব্যাংককে ইয়োলো জোনে থাকা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা শুরু হয়েছে, যেখানে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সিনিয়র সাংবাদিক ও ইআরএফ-এর সাবেক সভাপতি শারমীন রিনভী বেনারকে বলেন, “সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা সত্যিই নজিরবিহীন এবং স্বাভাবিক কারণেই সাংবাদিকদের এই প্রতিবাদও নজিরবিহীন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ভূমিকা সাধারণ মানুষকে তথ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশ্যই অনতিবিলম্বে এই অবস্থান থেকে সরে আসা উচিত।”
তথ্য লুকাতে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ
সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ির ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) এবং বিভিন্ন পেশাজীবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।
প্রতিটি সংগঠনই দাবি করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত দুর্নীতিবাজ ও ব্যাংক লুটেরাদের জন্য আশীর্বাদ।
গত মঙ্গলবার ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তথ্য লুকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানে সাংবাদিক প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।