বাংলাদেশ ব্যাংক ভল্টের সোনা নিয়ে কারচুপির অভিযোগ
2018.07.17
ঢাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা সোনার মান নিয়ে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—এনবিআর। প্রায় এক বছর তদন্তের পর অনিয়মগুলো একে একে চিহ্নিত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই অভিযোগ মানতে রাজি নয়। তাঁদের দাবি, ব্যাংকের এই ভল্ট সুরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া সেখানে গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নরেরাও ঢুকতে পারেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সোনা রাখার পর কারসাজির বিষয়ে শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মঙ্গলবার দৈনিক প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য খণ্ডণ করে।
শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি ২০১৫ সালে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের একটি সোনার চাকতি ও আংটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রেখেছিল। দুই বছরের মাথায় সোনার বদলে সংকর ধাতু ও ২২ ক্যারেট সোনার বদলে ১৮ ক্যারেট সোনা পাওয়া যায়। দৈবচয়ন ভিত্তিতে ভল্টে রাখা ৯৬৩ কেজি সোনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ অনিয়ম ধরা পড়ে। এতে সরকারের ক্ষতি হয় প্রায় এক কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে ভল্টে রাখার পর ওই সোনা কে বা কারা বদলে ফেলেছে। অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করে, ভল্টে রাখা সোনা ঠিকই আছে। কাগজপত্রে কিছু ছাপার ভুল ছিল, এ জন্য দায়ী করণিকেরা।
তবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর নিজেদের তদন্ত সম্পর্কে অনড় রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তদন্তের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক রবিউল হাসান সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন।
“যিনি সোনার চাকতিটি ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন তিনি নিজে এসে সেটা পরীক্ষা করে লিখিত প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন যে, চাকতিটি যেভাবে জমা রাখা হয়েছিল সেভাবেই আছে। এ ছাড়া চাকতির সোনার বিষয়ে ক্ল্যারিকাল মিসটেক হয়েছে,” রবিউল হাসান বলেন।
ক্ল্যারিকাল মিসটেকটা কেমন তার ব্যাখ্যায় ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার (মহাব্যবস্থাপক) আওলাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দেওয়া সোনা জমা রাখার সময় সোনা ৪০ শতাংশ ছিল। ইংরেজি বাংলার হেরফেরে সেটা নথিতে ৮০ শতাংশ লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণকার এই ভুল করেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে শুল্ক গোয়েন্দার স্বর্ণ পরিমাপের পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা করেন নির্বাহী পরিচালক রবিউল হাসান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কষ্টিপাথরে সোনার মান যাচাই করে। শুল্ক গোয়েন্দা করে বাইরে থেকে ভাড়া করা মেশিনে। তাই সোনার মানে তফাৎ হয়েছে।
গতকাল ওই সংবাদ সম্মেলনের পর যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং ব্যাংক খাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার অর্থনীতবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য হাস্যকর উল্লেখ করে বেনারকে বলেন, এই সরল ব্যাখ্যা অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই।
শুল্ক গোয়েন্দারা অনড়
বাংলাদেশ ব্যাংক বক্তব্য দেওয়ার পরও ঢাকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করলে আবারও তদন্ত করে দেখতে পারে। তবে তাঁদের তদন্ত যথার্থ বলে মত দেন তিনি।
এদিকে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থায় এই অনিয়মের তদন্ত হবে কি না সে প্রশ্ন করেছেন অনেকে।
এর আগে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা চুরি যায়। ওই চুরির ঘটনায় সত্যিকার অর্থে কারা কারা কোন পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন, সে সম্পর্কে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, এ দেশের নাগরিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০৮ কোটি টাকা চুরি গেল। ওই ঘটনার সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন, যেনেতেন ব্যাখ্যা দিয়ে নয়, এখন কাজের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।