দুদক কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় নজিরবিহীন প্রতিবাদ

আহম্মদ ফয়েজ
2022.02.17
ঢাকা
দুদক কর্মকর্তাকে চাকুরিচ্যুতির ঘটনায় নজিরবিহীন প্রতিবাদ সহকর্মীর চাকুরিচ্যুতির প্রতিবাদে ও দুদক কর্মচারী (চাকুরী) বিধিমালা ২০০৮ এর একটি বিধি বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী মানববন্ধন করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা কর্মচারীরা। ছবিটি দিনাজপুর দুদক কার্যালয়ের। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[বেনারনিউজ]

একজন সহকর্মীকে হঠাৎ করে চাকুরিচ্যুত করার ঘটনায় নজিরবিহীন আন্দোলন করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। বুধবার এই চাকুরিচ্যুতির ঘটনার পর বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রধান কার্যালয়সহ সারাদেশে মানববন্ধন করেছেন দুদক কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।

বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ্ স্বাক্ষরিত এক আদেশে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকুরী) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধিতে দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো: শরিফ উদ্দীনকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার প্রায় তিনশ' জনের স্বাক্ষরে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশন সচিব মো: মাহবুবুর রহমানের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন।

পাশাপাশি ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরের ২১টি কার্যালয়ের সামনে দুদক চাকুরি বিধিমালার ওই ধারাটি বাতিল ও শরিফের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহারের দাবি জানান দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) নং বিধিতে বলা হয়েছে “কর্তৃপক্ষ কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ দিয়ে অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করে তাঁকে চাকরি হতে অপসারণ করতে পারবে।”

অন্যদিকে সংবিধানের ১৩৫(২) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, “অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাবে না।”

শরিফের চাকুরিচ্যুতির ঘটনাকে অসাংবিধানিক, বে-আইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী দাবি করে এতে বলা হয়, “শরিফ উদ্দীন চট্টগ্রামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।”

এতে বলা হয়, “শরিফ চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ৫২টি মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া তিনি বিজ্ঞ আদালতের বিচারার্থে ১৫টি চার্জশিট দাখিল করেন। তিনি কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদঘাটনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।”

“শরিফ উদ্দিনের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে সংক্ষুব্ধ পক্ষগুলো বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। কোনোরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনো অপরাধ করেছেন কি না, তা অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁকে চাকরি থেকে অপসারণ করা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী,” স্মারকলিপিতে বলা হয়।

আদালতে বিচারাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিতর্কিত ৫৪(২) ধারা মোতাবেক শরিফকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিলের দাবি জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারীরা।

পাশাপাশি এই ধারা বাতিল করে কমিশনের কর্মকর্তাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের দাবি জানান তারা।

কী কারণে চাকরিচ্যুতি, বলছে না দুদক

কী কারণে শরিফকে চাকুরিচ্যুত করা হলো এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে দুদক সচিব বলেন, “তাঁকে চাকরিচ্যুত করার বিকল্প ছিল না।”

তিনি সাংবাদিকদের বলেন “দুদকের ভাবমূর্তি রক্ষায় শরিফকে অপসারণ করা হয়েছে। তিনি (শরিফ) দুদকের বিধিবিরোধী কাজ করেছেন।”

বিধিবিরোধী কী কাজ করেছেন এবং কেন চাকুরিচ্যুতির আগে শরিফকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি জানতে চাইলে দুদক সচিব বেনারকে বলেন, “তাঁকে (শরিফ) নিয়ম মেনেই চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে এবং তিনি কী করেছেন তা আমি জনসমম্মুখে বলতে চাই না।”

চাকরিচ্যুত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি

গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চাপের কারণেই দুদক কর্মকর্তা শরিফকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

“এ নিয়ে সংস্থার অভ্যন্তরে এবং বাইরে বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এই চাকুরিচ্যুতির প্রতিবাদে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে দুদকের কর্মীদের অংশগ্রহণে মানববন্ধনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। যা যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি উদ্বেগজনক,” বলছে টিআইবি।

এতে বলা হয়, শরিফ চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় দক্ষতা ও সাহসের সাথে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মামলা পরিচালনায় মূল ভূমিকায় জড়িত ছিলেন।

“এসব অভিযান ও মামলায় সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মধ্যে যাদের বিরাগভাজন হচ্ছিলেন এই কর্মকর্তা, তাদের চাপের কারণেই কি শরিফকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করা এবং সর্বশেষ চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে- এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠেছে,” বলছে টিআইবি।

সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে দুদকের অবস্থান পরিষ্কার করার দাবি জানিয়ে টিআইবি বলছে, “জনমনে তৈরি হওয়া এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুর্নীতি দমনে কাজ করা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করে টিআইবি।”

আমি ভিকটিম, নিরপরাধ: শরিফ

তাঁর বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে শরিফ বেনারকে বলেন, “আমি কোন অপরাধ করিনি। আমার সাথে অপরাধ হচ্ছে। আমি ভিকটিম।”

দুর্নীতি বিরোধী কাজের জন্য কিছু মানুষের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন দাবি করে তিনি বলেন, “আমি ন্যায় বিচার চাই।”

তিনি জানান, চাকরিচ্যুত করার ১৬ দিন আগে তিনি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন।

এ ঘটনার অভিযোগে থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) তিনি উল্লেখ করেন, “আমি কীভাবে চাকরি করি, তিনি দেখে নেবেন। আমি চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালীন অনেকের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি, দুদক দিয়ে আমার জীবন নষ্ট করে দেবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।