বিরোধিতার মুখে পিছু হটল সরকার, গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাচ্ছে না আনসার
2023.10.25
ঢাকা

পুলিশের তীব্র আপত্তির মুখে ‘সহায়ক নিরাপত্তা বাহিনী’ আনসারকে পরিপূর্ণ বাহিনী হিসেবে গঠন করে আটক, তল্লাশি ও জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
ক্ষমতা প্রদানের বিতর্কিত এই সিদ্ধান্ত সোমবার জাতীয় সংসদে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ আকারে উত্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
বিলটি উপস্থাপিত হওয়ার পর তা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং পুলিশ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের বিরোধিতার মুখে পড়ে।
আনসার বাহিনীকে আটক ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া দেশে “মারাত্মক পরিস্থিতির” সৃষ্টি করবে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে “জালিয়াতি” করতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
সরকারের মতে, ১৯৯৫ সালের ব্যাটালিয়ন আনসার আইনে বিদ্রোহ এবং এ সংক্রান্ত গুরুতর অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে উপযুক্ত করতে এবং বিদ্রোহ সংক্রান্ত অপরাধ বিচারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করতেই এই আইন।
প্রকাশ্যে এই আইনের বিরোধিতা করছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশ সমিতির সভা
সংসদে বিল পাশ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পুলিশ সমিতির নেতা এবং আনসার বাহিনীর প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ.কে.এম. আমিনুল হক এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা অংশ নেন।
সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে সংসদে উত্থাপিত আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩ এর বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরা হয়। তবে ওই বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বুধবার পুনরায় বৈঠকে বসেন তাঁরা।
পুলিশের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার বেনারকে বলেন, “পুলিশ চায় না আনসার বাহিনীকে গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া হোক। তাদের আপত্তি আইনের সাত ও আট ধারায়। আমি তাঁদের আশ্বস্ত করেছি, ওই দুই ধারা থাকবে না। অর্থাৎ আনসারকে গ্রেপ্তার অথবা তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়া হবে না।”
তিনি বলেন, “আগামীকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সুপারিশ করবে। ওই দুই ধারা বাদ দিয়ে বিদ্রোহ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের বিধান করতে এই আইনটি পাশ করা হবে।”
আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩ এর ৭ ও ৮ ধারা অনুসারে বাহিনীটি অপরাধীকে আটক এবং ক্ষেত্র বিশেষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ মোতাবেক আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি করতে পারবে এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।
বিলটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছে।
পুলিশ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, “আনসারকে আটক ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দিতে সংসদে যে বিল উত্থাপিত হয়েছে, আমরা এটির বিরোধিতা করি। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, এই কাজ পুলিশের। এই বিল পাশ হলে দেশে দু’টি পুলিশ বাহিনী থাকবে এবং অরাজকতা সৃষ্টি হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে ওই বিলের সাত ও আট ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছি। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, আনসারকে ওই ক্ষমতা দেওয়া হবে না। আমরা সেটি বিশ্বাস করি।”
ফারুক হোসেন বলেন, “আনসার বাহিনীকে আটক ও তল্লাশির ক্ষমতা দেয়া হবে সংবিধান পরিপন্থী সিদ্ধান্ত।”
তিনি বলেন, “আনসার বাহিনী একটি সহায়ক নিরাপত্তা বাহিনী। তারা পুলিশের সহায়ক বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। এটিকে মূল বাহিনী হিসেবে তৈরি করার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।”
‘দু’টি পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হবে’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ.কে.এম, শহিদুল হক বেনারকে বলেন, “আনসার বাহিনীকে গ্রেপ্তার ও দেহ তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়ার জন্য যে বিল উত্থাপন করা হয়েছে, সেটি সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। ফৌজদারি কার্যবিধি (কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিজার) অনুযায়ী গ্রেপ্তার, আটকের ক্ষমতা একমাত্র পুলিশ বাহিনীর হাতে থাকবে। আনসার বাহিনী পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করবে।”
শহিদুল হক বলেন, “যদি আনসার বাহিনীকে আটক ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে দেশে দু’টি পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হবে। একটি দেশে দু’টি পুলিশ বাহিনী থাকতে পারে না। এটি করা হলে তৃণমূলে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। যার প্রভাব খুব খারাপ হবে।”
“বিশেষ করে দেশের নিম্ন ও সাধারণ মানুষ আনসার বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হবে। সাধারণ মানুষের জন্য এই বাহিনী একটি বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আনসার বাহিনীর তদন্ত করা অথবা আটক ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করার মতো সক্ষমতা নেই,” বলেন তিনি।
“নির্বাচনের আগে সরকার কার স্বার্থে এই বাহিনীকে আটক ও তল্লাশির ক্ষমতা দেবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটি বোধগম্য নয়,” বলেন শহিদুল হক।