অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন আলোচনা

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.10.30
ঢাকা
অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় নিয়ে  ঢাকা-ওয়াশিংটন আলোচনা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি অ্যাপাচে হেলিকপ্টার। উত্তর কোরিয়ার সীমান্তের কাছে। এপ্রিল ২৬, ২০১৭ ।
ছবি: এপি

সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের অংশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অ্যাপাচে কমব্যাট হেলিকপ্টার, জঙ্গি বিমান এবং ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা কিনতে বাংলাদেশ আলোচনা শুরু করেছে।

এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্ণেল (অব.) ফারুক খান। বেনারকে তিনি বলেন,  আমেরিকান অ্যাপাচে হেলিকপ্টার, আধুনিক জঙ্গিবিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করবে।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই প্রথম উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জামাদি কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বখ্যাত সামরিক প্রকাশনা জেন’স ডিফেন্স ম্যাগাজিন বুধবার লিখেছে, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে।

চুক্তি দুটো হলো; আকসা বা দ্য একুইজেশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট হচ্ছে সামরিক রসদবিষয়ক একটি রূপরেখা চুক্তি। আর জিসোমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) হচ্ছে মার্কিন সরকার ও মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সইকারী দেশের সরকার ও সমরাস্ত্রবিষয়ক বিশেষায়িত সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত গোপন তথ্য বিনিময়ের চুক্তি।

এ বিষয়ে একজন মার্কিন কর্মকর্তা বেনার নিউজকে বলেন, ''যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই ধরণের চুক্তি শতাধিক দেশের সঙ্গে রয়েছে। এই ধরণের চুক্তি কোনো ভাবেই কোনো সামরিক কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি দেয় না।''

বাংলাদেশের শীর্ষ বাংলা দৈনিক প্রথম আলোতে গত আগষ্টে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ১৩ এপ্রিল ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে আকসার প্রসঙ্গটি তুলেছেন। ঢাকায় গত ২ মে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সংলাপে আকসা ও জিসোমিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

জেন’স এর মতে, চুক্তি দুটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জামাদি পাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সরঞ্জামাদির প্রধান সরবরাহকারী দেশ চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ শুরু করা হলে আপাতদৃষ্টিতে সেটি হবে বাংলাদেশের সামরিক ক্রয় নীতির পরিবর্তন।

বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের ব্যাপারে সেনা প্রধান আজিজ আহমেদ সম্প্রতি এক সামরিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন থেকে উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করবে।

কর্ণেল ফারুক খান বেনারকে বলেন, “আমেরিকা থেকে অ্যাপাচে হেলিকপ্টার ও মিসাইল ব্যবস্থা কেনা হলে তা বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী আধুনিকায়নে সহায়তা করবে।”

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অল্প হলেও সামরিক সরঞ্জামাদি পেয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলির এই সদস্য বলেন, “আমাদের সরকার দেশের সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নে সব সময় সচেষ্ট। আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে চাই। আর সেকারণেই আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করছি।”

ফারুক খান বলেন, “এর কারণ বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উন্নয়নের রোল মডেল। আরেকটি হলো জাতিসংঘ মিশনসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সর্বোচ্চ পেশাগত দক্ষতা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ। তবে সশস্ত্রবাহিনী দেশের বিরুদ্ধে যে কোনও আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম।”

পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বেনারকে জানান, তিনি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত দুটি চুক্তির ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সরঞ্জামাদি তেমন বিক্রি করেনি। ফলে সামরিক সরঞ্জামাদির জন্য চীন, রাশিয়ার ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে যায় বাংলাদেশ।

সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশন্যাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসাবে আশির দশকে চীনের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে সামরিক সরঞ্জামাদি কিনতে থাকে বাংলাদেশ।

তবে ২০০০ সালের পর চীনের একচ্ছত্র প্রভাব কমে আসে। তবে, ২০১০ সালের পর থেকে চীন আবার বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সিংহভাগ সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে আসছে।

পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হিসাবে, ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেছে চীন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “দেখুন বাংলাদেশের মত ছোট আয়তনের দেশে বিমান বাহিনীর একটি বড় ভূমিকা দরকার। আর এ জন্য উন্নত জঙ্গি বিমান ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার খুব বেশি দরকার।”

তিনি বলেন, “তবে বাংলাদেশ সামরিক সরবরাহের জন্য চীনের ওপর বেশ নির্ভরশীল। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের মোটামুটি প্রধান সামরিক সরবরাহের উৎস হয়ে ওঠে চীন।”

ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা সামরিক সরবরাহ পাইনি তা নয়। তবে এর পরিমাণ খুবই কম।”

তিনি বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কাছে সামরিক সরঞ্জামাদি বিক্রি করত না যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া, আমরা তাদের সামরিক সরঞ্জামাদির গোপনীয়তা রাখতে পারবো কি না, সে কথা চিন্তা করেও আমাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেনি।”

তাঁর মতে, বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর জঙ্গি বিমান মূলত রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশ থেকে কেনা। আমাদের বিমান বাহিনীতে চীনা কোন হেলিকপ্টার নেই বলেও জানান তিনি।

সাখাওয়াত বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের কাছে অত্যাধুনিক অ্যাপাচে হেলিকপ্টার বিক্রি করলে সেটি হবে আমাদের জন্য বড় বিষয়।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জামাদির ক্রয়ের ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে, সশস্ত্রবাহিনীর মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ জানান, ২২ অক্টোবর নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসের একটি অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান এ সম্পর্কে বক্তব্য দেন।

তিনি বলেন, ভিশন-২০৩০ অনুযায়ী বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীকে যুগোপযোগী করা হচ্ছে।

সেনা প্রধান আজিজ আহমেদকে উদ্ধৃত করে লে. কর্ণেল জায়েদ বেনারকে বলেন, “আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন মজবুত হচ্ছে। আমরা চাইব আগে আমাদের যে ধরনের সরঞ্জাম ছিল, তার চেয়ে আধুনিক সরঞ্জাম কেনার জন্য।”

তিনি বলেন, “আমাদের বিমান বাহিনী যেমন চাচ্ছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, তেমনি সেনাবাহিনী চাচ্ছে সর্বাধুনিক ট্যাঙ্ক কিনতে। অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতি হওয়ায় আমরা এখন আর কম দামি সমরাস্ত্র কিনব না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।