দুর্বল পদ্মা ব্যাংক একীভূত হলো এক্সিম ব্যাংকে

রিয়াদ হোসেন
2024.03.18
ঢাকা
দুর্বল পদ্মা ব্যাংক একীভূত হলো এক্সিম ব্যাংকে ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন রিকশাচালকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রতিবেদনে পদ্মা ব্যাংকসহ দেশের ৯টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর বলে চিহ্নিত করে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
[রয়টার্স]

আর্থিকভাবে ভঙ্গুর পড়া পদ্মা ব্যাংক তুলনামূলক সবল এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটিই বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম একীভূত হওয়ার ঘটনা।

সোমবার রাজধানীর মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়।

দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাপ তৈরি করার পর কোনো ব্যাংকের স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা।

এই একীভূতকরণ এমন সময়ে ঘটল যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেশের ৯টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর হওয়ায় সেগুলো রেড জোনে রয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে পদ্মা ব্যাংক একটি।

চুক্তি স্বাক্ষর শেষে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, “আজ বা কাল থেকে পদ্মা ব্যাংকের আর কোন অস্তিত্ব থাকবে না। পদ্মা ব্যাংকের সব দায়দেনা এক্সিম ব্যাংক গ্রহণ করল।”

পদ্মা ব্যাংক এখন থেকে এক্সিম ব্যাংক নামে চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, “পদ্মা ব্যাংকে গ্রাহকের যেসব আমানত আছে, চাইলে কেউ তা নিয়ে নিতেও পারবে।”

চুক্তি স্বাক্ষর শেষে পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আফজাল করিম বেনারকে বলেন, “আমাতনকারীদের স্বার্থে এই একীভূতকরণ, এর ফলে তাঁদের স্বার্থ শতভাগ সংরক্ষিত থাকবে।”

বেসরকারি খাতের মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “এটি ভালো উদ্যোগ। এর ফলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা হবে।”

তিনি বলেন, “এর আগে সরকারি ব্যাংক একীভূতকরণ হয়েছিল। কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক অধিগ্রহণ হয়েছিল। তবে বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক একীভূত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।”

এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক এ সংক্রান্ত এক সভা শেষে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়ার কথা জানান।

তিনি তখন সাংবাদিকদের বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবে এবং সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেবে।”

পদ্মা ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার কাজ শুরু হওয়ার পর অন্যান্য দুর্বল ব্যাংকও হয় চলতি বছরের মধ্যে স্বেচ্ছায় নয়তো আগামী বছর থেকে বাধ্যতামূলক একীভূতকরণের আওতায় আসতে বাধ্য হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে যে ৯টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বেশি খারাপ, সে তালিকায় পদ্মা ছাড়াও রয়েছে এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। এই তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংকের নামও আছে।

অবশ্য মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত হোক না কেন, এতে আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না, সেখানে আমানতকারীদের স্বার্থ শতভাগ রক্ষা করা হবে।”

এ সময় পদ্মা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আফজাল করিম আশা করছেন, একীভূত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নীতি সহায়তা দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, “দুটি ব্যাংকের সম্পদ ও দায় রয়েছে, যা একটি অডিট ফার্ম দিয়ে মূল্যায়ন করা হবে।”

পদ্মা ব্যাংকের ঋণের ৬১ শতাংশই খেলাপি

পদ্মা ব্যাংকটির ঋণের ৬১ শতাংশ খেলাপি বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেনর এটির চেয়ারম্যান আফজাল করিম।

অথচ বাংলাদেশকে গত বছর ৫৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় শর্ত হিসেবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যে শর্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দিয়েছিল, সেখানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল।

অর্থাৎ সংস্থাটির মানদণ্ডের বিবেচনায় পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত ছয় গুণ বেশি।

অবশ্য আফজাল করিম বলেন, “ব্যাংকটিতে গ্রাহকের ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে সম্পদ আছে পাঁচ হাজার সাতশ’ কোটি টাকা।”

পদ্মা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আর্থিক প্রতিবেদন অংশে ব্যাংকের আর্থিক বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ প্রায় পৌনে ছয় হাজার কোটি টাকা এবং মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৬শ’ কোটি টাকার বেশি। আর ব্যাংকটিতে কর্মীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

এমন একটি ভঙ্গুর ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের মতো অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকে একীভূত হওয়ায় ব্যাংকটির জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করবে কিনা কিংবা এতে সরকারের চাপ ছিল কিনা, এমন প্রশ্ন সামনে এসেছে।

সোমবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, “সরকার কোনো চাপ দেয়নি ব্যাংকটির সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে, তবে পরামর্শ দিয়েছে।”

“অর্থনীতির স্বার্থে আমরা জেনেশুনে এ বোঝা নিয়েছি,” বলেন তিনি।

নাম বদলেও টিকতে পারল না পদ্মা

২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়ার চার বছরের মাথায়ই সংকটে পড়ে পদ্মা ব্যাংক। এই ব্যাংকটি অনুমোদন পেয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক নামে, যার চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দিন খান আলমগীর।

ঋণ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পর ব্যাংকটির স্বাস্থ্য দিনে দিনে খারাপ অবস্থায় যায়। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দি ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।

এর মধ্যেই ব্যাংটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে যুক্ত হন ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিস সরাফাত। এর পর থেকে ব্যাংকটিতে টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিস্তর ছাড় দিয়ে গেছে। যার মধ্যে ছিল ৯০০ কোটি টাকার বেশি লোকসানে থাকা ব্যাংকটিকে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে এ লোকসান না দেখানোর সুযোগ দেওয়া, লোকসানের বিপরীতে অদৃশ্য সম্পদ সৃষ্টি করার সুযোগ দেওয়া।

তবুও সাফল্যে না পেয়ে ‌‘স্বাস্থ্যগত ও ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান নাফিজ সরাফাত।

পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কেউ নতুন ব্যাংকে থাকতে পারবেন না বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের পরিচালকরা নতুন ব্যবস্থাপনায় থাকবেন না, তারা শুধু শেয়ারহোল্ডার থাকবেন। এমনকি পদ্মা ব্যাংকের নামও বিলুপ্ত হবে।

সুশাসন নিশ্চিত না হলে লাভ হবে না

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একীভূতকরণ করে কার্যকর সমাধান মিলবে না, যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায়। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার মূল কারণ সুশাসনের অভাব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “সুশাসন ঠিক না হলে একীভূতকরণে সমাধান আসবে না।”

তিনি বলেন, “সৎ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিয়োগ দেওয়া, তাদেরকে জবাবদিহির মধ্যে আনা এবং যাতে কোন আঁতাত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”

বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বেনারকে বলেন, “কেবল পদ্মা ব্যাংক নয়, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দুর্বল হয়েছে সুশাসনের অভাবে।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। সেখানে ব্যাংকের সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতেই হতো। ফলে একীভূতকরণ একটি সমাধান। কিন্তু মূল কাজ হলো আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা।”

উল্লেখ্য, গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বড়ো বড়ো ঋণ কেলেঙ্কারির বিস্তর ঘটনা সামনে এসেছে। কিন্তু এসব ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে বহু কথা বলা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।