ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত

শরীফ খিয়াম
2020.12.08
ঢাকা
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত রাজশাহীর চর খিদিরপুর এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবির টহল। ১৩ জুলাই ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। 

মঙ্গলবার এই ঘটনার পর বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিএসএফের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ‘কোম্পানি কমান্ডার’ পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিবির ঠাকুরগাঁও ব্যাটালিয়নের (৫০-বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শহিদুল ইসলাম। 

“বিজিবির পক্ষ থেকে এই ঘটনার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে, এটা ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন,” বলেন তিনি। 

“বৈঠকে বিএসএফ কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ২০-৩০ জন চোরাকারবারী সংঘবদ্ধভাবে হামলা করায় তাদের জওয়ানরা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে,” যোগ করেন শহিদুল ইসলাম। 

এ বিষয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাথে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 

মঙ্গলবারের এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বেতনা সীমান্তে। 

হরিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আওরঙ্গজেব জানান, ওই ঘটনায় নিহতরা হলেন হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের মানিকখাড়ি গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে নাজির উদ্দীন এবং বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড় পলাশবাড়ি ইউনিয়নের মশালডাঙ্গী গ্রামের ভক্কু মিঞার ছেলে রবিউল ইসলাম। তাঁদের বয়স ২৮-৩০ বছর। 

নিহত নাজিরের ভাই মোজাম্মেল হক অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন জানিয়ে ওসি বেনারকে বলেন, “যারা সীমান্তের কাঁটাতার কেটে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে যায়, তারাই মূলত বিএসএফের গুলিতে আহত বা নিহত হয়।” 

তিনি বলেন, “সাধারণত চোরাকারবারী, বিশেষ করে গরু পাচারকারীরাই এভাবে ওপারে যায়। চোরাকারবারই স্থানীয় বেশিরভাগের পেশা।” 

“বিভিন্ন সময় আমরা তাদের সতর্ক করি। অন্য কাজ করতে উৎসাহ দেই। কিন্তু দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভে তারা এমন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যুক্ত হয়। সীমান্তে বিজিবি সার্বক্ষণিক টহল দিলেও তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না,” বলেন ওসি আওরঙ্গজেব। 

তবে বকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বর্ষা জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চোরাই গরু জব্দ করা নিয়ে বিজিবি-গ্রামবাসীর সংঘর্ষে তিন জন নিহত হওয়ার পর এই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। 

“ওই ঘটনার পর এলাকায় কোনো চোরকারবারীও ধরা পড়েনি,” বলেন চেয়ারম্যান বর্ষা। 

কাজের খোঁজে পাঞ্জাব যাচ্ছিলেন!

কাঁটাতার কেটে ওপার থেকে গরু নিয়ে আসা চোরাকারবারীরা সাধারণত রাতের মধ্যেই গিয়ে ফিরে আসে জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বর্ষা বেনারকে বলেন, “মঙ্গলবারের ঘটনাটিকে যেহেতু সকালের এবং নিহতদের সাথে কোনো গরু ছিল না, এ ক্ষেত্রে নিহতরা পাচারকারী নাও হতে পারে।” 

“নিহতদের স্বজন আর প্রতিবেশীরা বলেছেন, তারা কাজের খোঁজে ভারতে যাচ্ছিল। ওই এলাকা থেকে অনেকেই গোপনে পাঞ্জাব রাজ্যে কাজ করতে যায়,” যোগ করেন এই ইউপি চেয়ারম্যান। 

তিনি বলেন, “মাঝে করোনার কারণে তাদের যাওয়া-আসা বন্ধ ছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে; স্থানীয় লোকজন এমনটাই বলছে।” 

এ তথ্য সমর্থন করে ওসি আওরঙ্গজেব জানান, কাজের খোঁজেও অনেকে অবৈধ পথে ভারতে যায়। তবে তাদের সংখ্যা খুব কম।  

সীমান্তে দশ মাসে নিহত ৪০

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম ১০ মাসে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ৪০ বাংলাদেশি। এর মধ্যে গুলিতে মারা গেছেন ৩৪ জন, বাকি ছয়জন মারা গেছেন বিএসএফের নির্যাতনে। 

আসক’র হিসেবে গত বছর সীমান্তে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছিলেন ৪৩ জন বাংলাদেশি। 

অন্য মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এর হিসাবে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএসএফ এর হাতে সীমান্তে হত্যার শিকার হয়েছেন এক হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশি। 

গত সেপ্টেম্বরে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী সম্মেলনের আলোচ্যসূচির এক নম্বরেই ছিল ‘সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি/হত্যা/আহত করা’র বিষয়টি। 

তখন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সীমান্তে হত্যার হার শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীও সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। 

তবুও এ জাতীয় ঘটনা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যাটি সমাধানের পথ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দরবারে না গেলে ভারতের সীমান্ত হত্যা থামাবে বলে আমি মনে করি না।”

“দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের সরকারের বিভিন্ন স্তরের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনটা আর যাতে না ঘটে সেজন্য যৌথ টহল, প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার না করাসহ নানা পন্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এটা কখনোই থামেনি,” বলেন ওই মানবাধিকার কর্মী। 

“গুলিবিদ্ধ লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসার কারণে ২০১১ সালের ফেলানী খাতুন হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। আর কোনো সীমান্ত হত্যার মামলা আদালত পর্যন্ত গিয়েছে বলে আমার জানা নেই,” বলেন তিনি। 

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশির নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে পশ্চিম বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিরীটি রায় বেনারকে বলেন, “প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যেখানে সম্পর্ক ভালো হওয়ার কথা সেখানে সীমান্তকে ‘হত্যার সীমান্তে’ পরিণত করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বিএসএফের পদস্থ কর্তা, পুলিশ আধিকারিক ও বিচার বিভাগ এই হত্যার ঘটনাগুলো দেখতেই পায় না। বিএসএফের পক্ষ থেকে প্রতিটি হত্যার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালনার দাবি করা হয়। সাজানো হয় নতুন নতুন মনগড়া গল্প।” 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।