ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে নতুন লাইন: মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্প শেষ হয়নি, এখন খরচ লাগবে প্রায় দ্বিগুণ
2023.01.05
ঢাকা

সাড়ে পাঁচ বছর আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে ১৭ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ করার কাজ নিলেও তা শেষ করতে পারেনি চীনা কোম্পানি। এতদিন পর এখন কোম্পানিটি বলছে, আর্থিক সংকটের কারণে তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ ছাড়া কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়ানোর দাবি তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চীনা কোম্পানিটি প্রকল্পের খরচ ৩৭৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন যে বাজেট করেছে তাতে প্রকল্পটির খরচ দাঁড়াবে ৭৮২ কোটি টাকা।
“চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পে নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তাদের ভাষ্য, ২০১৭ সালের তুলনায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেশি, তাই প্রকল্প খরচ বৃদ্ধি করা দরকার,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান।
খরচ বাড়ানোর বিষয়টির ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন “আলোচনার মাধ্যমে এবং চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে মিটারগেজ লাইনের পাশে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণে ২০১৭ সালের জুন মাসে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন চায়নার সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। দেড় বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে চার দফা সময় বৃদ্ধি করা হয়। এরপর সর্বশেষ বর্ধিত সময় বিদায়ী বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেও প্রকল্পটি শেষ হয়নি।
গত ২২ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় ঠিকাদারদের অবহেলার কারণে যেসব প্রকল্প গতি পাচ্ছে না সেগুলোর মধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ নির্মাণ প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়।
সদস্যদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সভায় প্রকল্পটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়, সভার কার্যপত্রের অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে ঠিকাদার পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লিমিটেড-এর আর্থিক সংকট অর্থাৎ “ক্যাশ-ফ্লো সমস্যার” কারণে নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
কার্যপত্রে আরও বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৯ জুন রেলওয়ের সঙ্গে কোম্পানির সম্পাদিত চুক্তি সাপেক্ষে নির্মাণ সামগ্রীর বর্তমান বাজার মূল্য অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠিকাদার সম্প্রতি “প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট” করার দাবি জানিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক সেলিম রউফ বেনারকে জানান, চীনা কোম্পানি এর আগে মূল্য বৃদ্ধির দাবি জানালেও তা মানা হয়নি।
তিনি বলেন, “এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের রেল যোগাযোগ অনেক সহজ হবে এবং ঢাকা মহানগরীর ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। ভবিষ্যতে এই লাইন পদ্মা সেতু রেল সংযোগের সঙ্গে যুক্ত হবে।”
ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্প
প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনের বর্তমান মিটারগেজ রেল লাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি সরকারের একনেক সভায় অনুমোদন পায়।
প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার প্রধান লাইন এবং পাঁচ কিলোমিটার লুপলাইন অর্থাৎ ১৭ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ করার কথা।
জাপানের ঋণ মুক্তি অনুদানের ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তিটি সই হয় ২০১৭ সালের ২০ জুন।
খরচ না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ প্রথমবারের মতো বাড়ানো হয় ২০১৯ সালের ৩০ জুন। এরপর দ্বিতীয়বার ২০২০ সালের ৩০ জুন, তৃতীয়বার ২০২১ সালের ৩০ জুন এবং চতুর্থবার গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না লিমিটেড-এর মন্তব্য জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ঢাকায় চীনা দূতাবাসে ই-মেইল পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
“বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত চীনা কোম্পানিগুলো অল্প টাকায় দর দিয়ে কাজ নেওয়ার পর সরকারের কাছে বাড়তি টাকা দাবি করে। সেই টাকা না দিলে তারা কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। অর্থাৎ তারা কাজ পাওয়ার পর সরকারকে জিম্মি করে ফেলে,” বেনারকে চীনা কোম্পানির এই কৌশলের কথা জানান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আহসান এইচ. মনসুর।
তিনি আরও বলেন, “এমতাবস্থায় সরকার কিন্তু তাদের বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য হয়। এভাবে দেখা যায় খরচ প্রায় দুই থেকে তিন গুণ হয়ে যায়।”
অধ্যাপক মনসুর বলেন, “এই সুবিধা তারা একা নেয় না। এর সঙ্গে আমাদের কিছু সরকারি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জড়িত। ঠিকাদারদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ থাকে।”