বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান নীতিতে চীনের সমর্থন

আহম্মদ ফয়েজ
2023.03.14
ঢাকা
বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান নীতিতে চীনের সমর্থন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসন্ন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন দাবিতে ঢাকায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল। ৩১ জানুয়ারি ২০২৩।
[এএফপি]

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যেভাবে বাংলাদেশকে যেভাবে তাগিদ দিচ্ছে, তা প্রত্যাখ্যান নীতিকে সমর্থন দিচ্ছে চীন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান চীন সমর্থন করে।”

তিনি বলেন, “চীন সব সময়ই বাংলাদেশের বিশ্বস্ত কৌশলগত অংশীদার এবং বাংলাদেশের প্রতি চীন এই নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে।” 

মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত বাংলাদেশ-চীন সিল্ক রোড ফোরামের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।

সাম্প্রতিক কাতার সফর নিয়ে সোমবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন—কিছু দিন আগে আপনার দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে কিছু কূটনীতিক এসেছিলেন। গতকাল (রোববার) বিএনপি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা কূটনীতিকদের বলেছে, আপনার অধীনে ভোটে যাবে না। …সব কিছু মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছেন কি না?

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কে কী চাপ দিলো-না দিলো, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। জনগণের স্বার্থে যেটা করা দরকার, আমরা সেটাই করব।”

মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, “উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের আরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে পারি।”

IMG_3206.jpg
ঢাকার চীনা দূতাবাসে আয়োজিত এক সংলাপে কথা বলছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। ১৪ মার্চ ২০২৩। [বেনারনিউজ]

চীনের সঙ্গে কোনো দলের ‘মতপার্থক্য নেই

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম সিল্ক রোড ফোরামের পক্ষ থেকে চীনা রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া সংবর্ধনায় অংশ নেন।

ইয়াও ওয়েন বলেন, “তিন দলের তিন নেতার উপস্থিতি প্রমাণ করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে তাঁদের কোনো মতপার্থক্য নেই। তাঁরা এই সম্পর্ক সমর্থন করেন। চীন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করে।”

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আমির হোসেন আমু বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ খুশি হবে।”

মঈন খান বলেন, “চীন একটি বড়ো উন্নয়ন সহযোগী দেশ। চীন যেভাবে সহযোগিতা করছে সেভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হবে না।”

অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে তাতে চীন যুক্ত থাকবে।”

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে গণতন্ত্রকামী পশ্চিমা দেশগুলোর নানা ভূমিকা সম্পর্কে তৃতীয় রাষ্ট্রের বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়।

গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় রাশিয়ান দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, “রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি গ্রহণ করে, সেই দেশগুলোর প্রতি রাশিয়া পুরোপুরি সমর্থন জানায়।”

গত ২০ ডিসেম্বর এই বিবৃতি দেয় রাশিয়া। তার আগে ১৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ এক বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে সরকারের সমালোচনায় পড়েন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।

বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিবৃতিতে বিব্রত বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের পরামর্শেও বিরক্ত সরকার।

“আমরা চাই না রাশিয়া, আমেরিকা কেউ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক, এটা তাদের বিষয় নয়,” বলেন মোমেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশি কূটনৈতিকদের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “চায়না যখন পশ্চিমাদের অবস্থানের বিরোধিতা করে এর পেছনে পরিষ্কার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। মূল বিষয় হচ্ছে সব দেশই চায় তারা যেভাবে চলে অন্যরাও সেভাবে চলুক। এ কারণেই পশ্চিমারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় আর চায়না চায় বাংলাদেশ এগুলো তোয়াক্কা না করুক।”

বাংলাদেশের বিষয়ে চীনের নানা কারণে প্রচুর আগ্রহ রয়েছে জানিয়ে তৌহিদ বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশে ভারতের প্রতিবেশী এবং বর্তমান সরকারও ভারতের ঘনিষ্ঠ তাই চীন চাইবে এখানে যতটুকু সম্ভব আধিপত্য বজায় রাখতে।”

রাজনৈতিক সংলাপ প্রসঙ্গ

সোমবার সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “সংলাপ কার সঙ্গে করব? হ্যাঁ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি সংলাপ করেছি। তার ফল কী?”

ওই নির্বাচনে বিএনপি “নির্বাচনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি,” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরদিন মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কোনো সংলাপে যাবে না বিএনপি।

“তাঁর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আমরাও কোনো সংলাপ করব না। কারণ তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন না,” বলেন ফখরুল।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপের প্রসঙ্গে টেনে ফখরুল বলেন, “ওই সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আর কোনো বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হবে না, পুলিশি হয়রানি হবে না, গায়েবি মামলা হবে না। কিন্তু এর তিন দিন পর থেকে আমাদের প্রার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।