বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন বন্ধ চেয়ে চীনা সরকারকে চিঠি
2021.06.22
ঢাকা

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিশপ্ত স্থান হিসেবে আখ্যায়িত করে ওই প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধে মঙ্গলবার চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ২১ দেশের শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি।
চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপের যৌথ মালিকানায় নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াটের ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থায়ন করছে চীন।
বাঁশখালী প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে লেখা ওই চিঠিটি মঙ্গলবার চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পার্টি লিডারশিপ গ্রুপের সেক্রেটারি ওয়াং ওয়ান্টাওকে ই–মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা বিষয়ক কর্মজোটের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী।
চিঠির একটি কপি ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসেও পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বুধবার এই চিঠির একটি কপি ফ্যাক্সের মাধ্যমে চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।”
ওই চিঠিতে চীনা সরকারের কাছে এসএস পাওয়ার প্লান্টে অর্থায়ন বন্ধের আহ্বানের পাশাপাশি প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোকেও এই প্রকল্প থেকে সরে আসার অনুরোধ করা হয়।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা এবং দেশটির রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ২০১৯ সালে বেল্ট এন্ড রোড ফোরামে দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, “পৃথিবীকে রক্ষা করার স্বার্থে আমরা পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণ করব এবং অর্থায়ন করব পরিবেশ বান্ধব সবুজ ও পরিচ্ছন্ন প্রকল্পে।”
তাঁর এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে চিঠিতে বলা হয়, চীনা প্রতিষ্ঠান বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করলে তা হবে চীনা রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এতে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীনের ইকোনমিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল কাউন্সিলর বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন, চীনা সরকার পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্পে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে না। এই অবস্থানকে স্বাগত জানায় বিশিষ্টজন ও সংগঠনগুলো।
চিঠিতে সুনির্দিষ্ট চারটি দাবির প্রথমটিতে বলা হয়, “বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ থেকে চীনা প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের সম্পৃক্ততা প্রত্যাহার করুন।”
দ্বিতীয় দাবিতে বলা হয়, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো এবং ত্রুটিপূর্ণ পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) প্রতিবেদনের বিষয়টি তদন্ত করুন।”
তৃতীয় দাবিতে এই প্রকল্পে এবং প্রকল্প এলাকায় যারা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন এবং যেসব গ্রামবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়।
শেষ দাবিতে বলা হয়েছে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া কয়লা, তেল এবং গ্যাসসহ জীবাশ্ম জ্বালানীতে চলমান ও ভবিষ্যতের সকল বিনিয়োগ বাতিল করতে হবে।
চিঠিটিতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, জাপান, কানাডা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, ফিলিপাইন এবং নেদারল্যান্ডসহ ২১টি দেশের ১২৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও পরিবেশবাদিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এই চিঠির বিষয়ে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য জানা যায়নি।
চিঠির বিষয়ে অবগত নন সংশ্লিষ্টরা
চীনে পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বেনারকে বলেন, এই চিঠি সম্পর্কে তিনি অবগত নন, তবে এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়।
“এর আগেও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সময় দেখেছি কিছু লোক ও সংস্থা ইউনেসকোর কাছে চিঠি দিয়েছিল। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এরা অধিকাংশই নামসর্বস্ব,” বলেন মোহাম্মদ হোসাইন।
তিনি বলেন, সংস্থাগুলো যদি পরিবেশের জন্য খারাপ কিছু পায় তাহলে সরকারের সঙ্গে শেয়ার করলে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
“বিদেশি একটি রাষ্ট্রকে এভাবে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করার আহবান জানানো হতাশজনক,” যোগ করেন মোহাম্মদ হোসাইন।
প্রসঙ্গত, রামপাল বিদুৎ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে জানিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনেস্কোকে চিঠি দিয়েছিল কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন।
এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) এবাদত হোসেন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “এই চিঠি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই। তবে এখানে যদি বলা হয় আমাদের পাওয়ার প্লান্টে পরিবেশ দূষণ হবে বা মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তবে তা পুরোপুরি মিথ্যা। আমাদের সম্পর্কে তারা কেন এমন মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে, তা আমাদের জানা নেই।”
তবে এই চিঠি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বেনারকে বলেন, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। চীন সরকারের উচিত হবে চিঠিটি বিবেচনা করে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন থেকে সরে আসা, কারণ তারা পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রকল্পে মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এই প্রকল্পে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১২জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ছয় হাজারেরও বেশি শ্রমিক ও স্থানীয় গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগ্রুপ এস আলমের ৭০ শতাংশ মালিকানা রয়েছে এসএস পাওয়ারে। এ ছাড়া চীনের সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ২০ শতাংশ ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের ১০ শতাংশ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলারের প্রকল্প। এর ৭০ শতাংশের বেশি ঋণ হিসেবে আসছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক থেকে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটিতে বর্তমানে প্রায় চার হাজার বাংলাদেশি ও প্রায় এক হাজার চীনা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা।
এই চিঠিতে স্বাক্ষরদাতা প্রথম ১০জন হলেন, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, অধিকার কর্মী জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হামিদা হোসেন, নিজেরা করি সমন্বয়ক খুশি কবীর, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এবং বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শহীদুল আলম।