পরিবেশের বিবেচনা নয়, অর্থায়নের অভাবে দশটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.06.30
ঢাকা
পরিবেশের বিবেচনা নয়, অর্থায়নের অভাবে দশটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ঢাকায় কার্গো জাহাজ থেকে আমদানি করা কয়লা নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। ১৩ আগস্ট ২০২০।
[এএফপি]

দেশে প্রথমবারের মতো প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক দশটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে সরকার, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ পরিবেশ নয়, মূলত অর্থায়নের অভাব। কারণ নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক অন্য প্রকল্পগুলো বাতিল করেনি সরকার।  

বাতিল দশটি প্রকল্পের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল সাত হাজার মেগাওয়াটের বেশি, এর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন চায়না হুয়াদিয়ান হংকং কোম্পানি লিমিটেডের কারিগরি সহায়তায় প্রস্তাবিত কক্সবাজারের মহেশখালীর প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করছিল বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

রোববার সাংবাদিকদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

প্রতিমন্ত্রী জানান, যে ১০টি প্রকল্প বাতিল হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুব সামান্য। এর ফলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সমস্যা হবে না।

মহেশখালীর প্রস্তাবিত কেন্দ্রটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের মে মাসে চায়না হুয়াদিয়ান হংকং কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে পিডিবি।

পিডিবির জনসংযোগ পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, তিন বছর আগে চুক্তি সম্পাদিত হলেও মহেশখালীতে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুবই কম ছিল বলা যায়। 

তবে ১০টি প্রকল্প বাতিল করার ‘কয়েকটি কারণ’ রয়েছে বলে বেনারকে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন।

তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা পৃথিবীতে কয়লা বিরোধী একটি অবস্থান আছে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসাবে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করার একটি দায়িত্ব থেকে যায়।”

এছাড়া ২০১০ সালে সরকার যখন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করে তখন “কয়লা সস্তা ছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন “বর্তমানে কয়লা আমাদের জন্য আর সস্তা নয়। কয়লা পরিবহন ও সংরক্ষণ অনেক ব্যয়বহুল।”

তবে কয়লা ভিত্তিক যেসব প্রকল্পের “বাস্তবায়নের অগ্রগতি অনেক বেশি” সেগুলো বাতিল করা হয়নি বলে জানান মোহাম্মদ হোসেন। 

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা নাজুক ছিল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না।

পিডিবির তথ্যানুসারে, ওই সময়ে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি এবং ওইসব কেন্দ্রের সর্বোচ্চ দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪,৯৪২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ দৈনিক উৎপাদন ছিল ৪১৩০ মেগাওয়াট। 

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকার এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে। ফলে দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা এখন বেশি। ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৪৯ এবং সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

২০০৯ সালে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের হার ছিল শতকরা ৪৭ ভাগ। ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত সেই হার শতকরা ৯৯ ভাগের দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে চীনাদের সবচেয়ে বড়ো বিনিয়োগ রয়েছে।  

প্রস্তাবিত দশটি প্রকল্প বাতিল করলেও বর্তমানে চালু থাকা কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে রয়েছে। ওই একই স্থানে ১২৪৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে যাবে বলে জানিয়েছে পিডিবি।  

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বেসরকারিভাবে চীনা সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে ১,২৪৪ মেগাওয়াট সম্পন্ন একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্রটি আগামী বছর ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। 

চলমান প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়াবে

নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফরম তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “সরকার যে ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করেছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন করার মতো অবস্থা ছিল না। এগুলোতে কোনো দাতা অর্থ বিনিয়োগ করছিল না। সুতরাং, এগুলো বাতিল করে সরকার একটি আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে বলা যায়।”

তিনি বলেন, “তবে দেশে বড়ো বড়ো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। যেমন চীনা অর্থায়নে পায়রায় দুটি, বাঁশখালীতে একটি, ভারতীয় অর্থায়নে রামপালে একটি, জাপানী অর্থায়নে মাতারবাড়িতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।”

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সারা পৃথিবীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারণ কয়লা আর অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। কয়লা এখন ব্যয়বহুল। কয়লা পোড়ানোর কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। নদী নষ্ট হচ্ছে। বায়ূমান খারাপ হচ্ছে। মানুষের বিভিন্ন রোগ বালাই হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “সরকার বর্তমানে ১০টি প্রকল্প বাতিল করেছে। ভবিষ্যতে সরকারকে সব কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোও বাতিল করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি করবে ততোই দেশ-জাতির জন্য মঙ্গলজনক।”

আনু মুহাম্মদ বলেন, “প্রযুক্তির উন্নতির কারণে সৌর বিদ্যুৎ দিন দিন সহজলভ্য হয়ে উঠছে।” 

মূলত দাতা খুঁজে না পাওয়ার কারণেই দশটি কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বেনারকে বলেন, “বাকি প্রকল্পগুলো বাতিল না করার পেছনে কারণ রয়েছে।”

“যেমন পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। পায়রা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার কথা বলা হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “চীনারা বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে বিনিয়োগ করছে এর পেছনের কারণ মূলত বৈশ্বিক রাজনীতি।” 

বাতিল হওয়া প্রস্তাবিত বাকি নয়টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হলো, পটুয়াখালীতে দুটি ৬৬০ মেগাওয়াট, উত্তরবঙ্গ ১২০০ মেগাওয়াট, মাওয়া ৫২২ মেগাওয়াট, ঢাকা ২৮২ মেগাওয়াট, চট্টগ্রাম ২৮২ মেগাওয়াট, খুলনা ৫৬৫, বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ৭০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সিপিজিসিবিএল-সুমিতোমো ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বাতিল করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে জাপান এবং সিঙ্গাপুরের সহায়তায় প্রস্তাবিত প্রকল্পও রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।