ঢাকায় গার্ডার দুর্ঘটনা: সুরক্ষা নিশ্চিত করেনি চীনা প্রতিষ্ঠান

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.08.26
ঢাকা
ঢাকায় গার্ডার দুর্ঘটনা: সুরক্ষা নিশ্চিত করেনি চীনা প্রতিষ্ঠান ঢাকার উত্তরায় বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার চাপায় গাড়ি পিষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় সেখানকার ঝুঁকিপূর্ণ অরক্ষিত নির্মাণ প্রক্রিয়াটি আলোচনায় আসে। ছবিটি উত্তরার আজমপুর থেকে তোলা। ১৬ আগস্ট ২০২২।
[বেনারনিউজ]

ঢাকার উত্তরায় বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুয়া গ্রুপ কর্পোরেশন জনগণের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। আর সেকারণেই একটি প্রাইভেট কারের ওপর গার্ডার পড়ে গত ১৫ আগস্ট দুই শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। তাঁরা সকলেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন।

শুক্রবার উত্তরায় প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন শেষে চীনা কোম্পানির এই অবহেলার কথা জানান ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “যারা গার্ডার বসানোর কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন এ ঘটনায় তাঁদের দায় রয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। সুরক্ষা ও নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা হলেই প্রকল্পের কাজ আবার শুরু হবে। অন্যথায় কাজ শুরু হবে না।”

সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ শুরুর পর ডিসেম্বরের মধ্যে বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে প্রকল্পের কাজ “ত্বরান্বিত করতে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের সকল ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে,” শুক্রবার বেনারকে জানান সড়ক জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এ.কে.এম. মনির হোসেন পাঠান।

একটি বাজে কোম্পানি’

সাবেক সড়ক পরিবহন সচিব বেলায়েত হোসেন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বিআরটি প্রকল্পে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি মূলত চায়না গেজুয়া গ্রুপ লিমিটেডের অবহেলার কারণে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”

“গতবছর উত্তরায় যখন এই একই প্রকল্পে গার্ডার ধ্বসে পড়ে তখন আমি সচিব হিসাবে তদন্ত করে দেখেছি, চায়না গেজুয়া গ্রুপ লিমিটেড কাজের ব্যাপারে মোটেও সিরিয়াস নয়। এটি একটি বাজে কোম্পানি,” বলেন সাবেক এই সচিব।

বেলায়েত হোসেন বলেন, “এই কোম্পানির কোনো ক্যাশ ফ্লো নেই। একটু কাজ করে আবার বন্ধ করে দেয়। এরপর আমাদের কাছে টাকা চায়। টাকা পেলে কাজ করে। আবার অনেক সময় অগ্রিম টাকা চায়। এদের বদনাম সব জায়গায়।”

তিনি বলেন, “তাদের কাজের মান ভালো না হওয়ার মূল কারণ হলো, শতকরা ৩৩ ভাগ কম দরে কাজ নিয়েছে চায়না গেজুয়া লিমিটেড। সুতরাং, কাজের মান কেমন হবে তা বুঝতে পারছেন। এছাড়া জনগণের সুরক্ষার জন্য যে পরিমাণ সতর্কতা নেয়া দরকার সেটিও নেয়নি কোম্পানিটি।”

“এ ধরনের বৃহৎ প্রকল্পের কাজ করার ক্ষেত্রে যেখানে কাজ হয় সেই চৌহদ্দির মধ্যে সকল স্থান জনগণের চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু বিআরটি প্রকল্পে রাস্তা বন্ধ করা হয়নি,” বলেন বেলায়েত হোসেন।

“এ ছাড়াও, সেখানে যারা কাজ করবেন তাদের হেলমেট, বুট, গ্লাভসসহ বিভিন্ন প্রকারের সুরক্ষা সামগ্রী অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু এই প্রকল্পে এগুলোর ঘাটতি আমার নজরে পড়েছে এবং তাদেরকে বিষয়টি জানানো হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

সাবেক এই সচিবের মতে, বাংলাদেশের টেন্ডার প্রক্রিয়ার কারণে “এই ধরনের বাজে কোম্পানি কাজ পেয়ে যায়।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আইনানুযায়ী যে কোম্পানি সবচেয়ে কম দর দেবে, সেই কোম্পানিকেই কাজ দিতে হবে। চায়না গেজুয়া শতকরা ৩৩ ভাগ কম দরে কাজ করার প্রস্তাব দেয়ায় তারা কাজটি পেয়েছে।”

এ ধরনের বড়ো প্রকল্পের কাজ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সক্ষমতা বিচার করা দরকার বলে মনে করেন বেলায়েত হোসেন বলেন।

রাজধানী ঢাকার সাথে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের যোগাযোগ সহজ করতে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ ২০১২ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দফায় দফায় খরচ বৃদ্ধির পর বর্তমান খরচ চার হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কাজের মেয়াদও বার বার বৃদ্ধি করা হয়। এই প্রকল্পে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার।

তদন্ত শেষ হবে আগামী সপ্তায়

১৫ জুলাই বিআরটি প্রকল্পের গাজীপুর অংশে ক্রেন পড়ে এক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। গতবছর ১৪ মার্চ প্রকল্পের উত্তরা অংশে আব্দুল্লাহপুরের কাছে গার্ডার তোলার সময় একটি গার্ডার ভেঙে পড়ে। আহত হন তিন চীনাসহ মোট ছয় শ্রমিক।

ওই ঘটনা তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হলেও সেই তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ ১৫ আগস্ট গার্ডার পড়ে পাঁচ ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা হয়।

মামলার বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোহসিন বেনারকে বলেন, গার্ডার দুর্ঘটনার ওপর দায়ের করা মামলায় শুক্রবার পর্যন্ত মোট ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা সকলেই বাংলাদেশি এবং এই প্রকল্পে কর্মরত এবং যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম সরবরাহকারী।

আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই জামিনে আছেন জানিয়ে মোহসিন বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যু এবং জখম করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এদিকে ১৫ আগস্ট দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান নীলিমা আখতার শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”

“জনগণের সুরক্ষার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কী কী ব্যবস্থা নিতে পারত সে ব্যাপারে আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করব,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সুরক্ষা নিশ্চিত না করার জন্য ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারেও আমরা আলোকপাত করবো।”

আগামী সপ্তাহের মধ্যেই কমিটি তদন্ত কাজ শেষ করতে পারবে বলে জানান নীলিমা আখতার।

এই কোম্পানির বক্তব্য জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ঢাকাস্থ চীনরা দূতাবাসে ইমেইল করা হলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

তবে ঘটনার পর বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানিয়েছেন, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দোষী সাব্যস্ত হলে এবং বাংলাদেশ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাঁর সরকার তা মেনে নেবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।