বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের বাজার চীনের কাছে জিম্মি
2022.09.27
ঢাকা

বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার এখন চীনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করে না বলে জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
এর কারণ সাভারের হরিণধরা ট্যানারি এস্টেটের কেন্দ্রীয় ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্টের (ইটিপি) মাধ্যমে সেখানকার চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় উৎপাদিত দূষিত পদার্থ পরিশোধন হচ্ছে না। বিষাক্ত ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন তরল দূষিত পদার্থ ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে।
এই দূষণের কারণে চামড়া রপ্তানির জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। আর সনদ না পাওয়ায় অর্ধ প্রক্রিয়াজাত কাঁচা চামড়া (ওয়েট-ব্লু) চীনে রপ্তানি করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ।
চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূষণ বন্ধ করে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া গেলে চামড়া রপ্তানির বাজার বর্তমান সোয়া বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালের মধ্যেই কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
দূষণ বন্ধ না করলে কারখানা বন্ধের সুপারিশ
চামড়া শিল্পকে দূষণমুক্ত করতে সেখানকার কারখানাগুলোকে নিজ উদ্যোগে ইটিপি স্থাপন করতে দেয়ার পাশাপাশি হরিণধরার কেন্দ্রীয় ইটিপি কীভাবে কার্যকর করা যায় সেব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে মঙ্গলবার সরকারকে সুপারিশ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
শিল্প প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য সচিব ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সাভারের ট্যানারি এস্টেটের যেসব কারখানা পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি এবং পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে চায় না, সেসব ট্যানারি বন্ধ করে দেবে সরকার।
কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সাভারের ট্যানারি এস্টেটের সেন্ট্রাল ইটিপি তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে পারছে না। এই ইটিপির মাধ্যমে দূষিত পদার্থ ক্রোম আলাদা করা যায় না। ফলে দূষিত পদার্থ ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “এই দূষণের কারণে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশে রপ্তানি হয় না। আমাদের অন্যতম রপ্তানি পণ্য চামড়া রপ্তানির স্বার্থেই ট্যানারি শিল্পের দূষণ বন্ধ করতে হবে।”
হরিণধরা এস্টেটের ট্যানারি যেসব কারখানায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার উপযোগী চামড়া তৈরি করা হয় সেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তরল দূষিত পদার্থ ও কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
কেন্দ্রীয় ইটিপির সেগুলো পরিশোধন করে বিশুদ্ধ আকারে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে ফেলার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এতে দূষিত হচ্ছে নদী ও আশেপাশের পরিবেশ।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সাভারের ট্যানারি কারখানাগুলোতে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু ইটিপি পরিশোধন করতে পারে মাত্র ২৫ হাজার ঘনমিটার। সেখানে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থাই নেই।
তিনি বলেন, “আজকের সভায় বলেছি, যেসকল ট্যানারি কারখানা নিজস্ব উদ্যোগে নিজস্ব ইটিপি স্থাপন করবে তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া, যারা দূষণ বন্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি চাইবে তাদের সময় দেয়া হবে। আর যারা দূষণ বন্ধ করবে না, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেবে না সেসব কারখানা বন্ধ করবে সরকার।”
গত বছরের আগস্টে দূষণের দায়ে হরিণধরা এস্টেটের কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। কিন্তু তা কার্যকর করেনি শিল্প মন্ত্রণালয়।
এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার তিন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা একত্রিত সভা করেন।
সভায় অংশগ্রহণকারী পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাপেক্স, বে ট্যানারিসহ মোট চারটি কোম্পানিকে নিজ উদ্যোগে ইটিপি বসানোর অনুমতি দেয়া হলেও অন্যান্য দপ্তর তাদের সহায়তা করছে না বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে।
তিনি বলেন, “এই সকল কোম্পানিকে নিজস্ব ইটিপি স্থাপনের সুযোগ দিলে তারা দূষণ বন্ধ করবে এবং বিদেশে চামড়া রপ্তানি করতে পারবে।”
“আজকের সভায় বলা হয়েছে, হরিণধরা ট্যানারি কারখানা থেকে তরলের পরিমাণ যেন কোনোভাবেই ২০ হাজার ঘনফুটের বেশি না হয়। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ইটিপি পরিশোধন করতে পারবে। তবে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে,” বলেন জিয়াউল হক।
কেন্দ্রীয় ইটিপি কীভাবে কার্যকর করা যায় সেব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগের আলোচনাও হয়েছে বলে জানান তিনি।
দূষণের কারণে চীন ছাড়া রপ্তানি হয় না কোথাও
চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও পিকার্ড বাংলাদেশ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. সাইফুল ইসলাম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “একটি মাত্র কারণে আমরা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাচ্ছি না। সেটি হলো হরিণধরা ট্যানারি এস্টেটের কেন্দ্রীয় ইটিপি দূষণ বন্ধ করতে পারছে না।”
“লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ না থাকায় চীন ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে আমরা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারছি না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এর ফলে আমাদের এই খাত সঙ্কুচিত হচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে।”
বর্তমানে প্রতি বর্গফুট অর্ধ প্রক্রিয়াজাত বা ‘ব্লু-ওয়েট’ চামড়া চীনে ৭০ মার্কিন সেন্টে বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু সেই চামড়া যদি দেশে প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিসড হিসাবে বিক্রি করা হয়, তাহলে একই পরিমাণ চামড়া আড়াই ডলার দিয়ে বিক্রি করা যাবে বলে জানান তিনি।
“হরিণধরা এস্টেটের ইটিপি আধুনিকায়ন করে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, ব্লু-ওয়েট চামড়া রপ্তানি বন্ধ করতে হবে,” বলেন সাইফুল ইসলাম।
তাঁর মতে, ব্লু-ওয়েট চামড়া রপ্তানি বন্ধ করা হলে এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পাওয়া গেলে ২০২৪ সালের মধ্যে চামড়াখাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি সম্ভব।
ঢাকা থেকে কারখানা সরালেও দূষণ কমেনি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’র সহযোগী অধ্যাপক উত্তম কুমার রায় মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের পুরো প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ দূষণ হয় তার কমপক্ষে শতকরা ষাট ভাগ হয়ে যায় “ওয়েট-ব্লু” পর্যায়ে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লবণ দেয়া কাঁচা চামড়া ড্রাম নামক একটি বিশাল গোলাকার পাত্রে ঢুকিয়ে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দিয়ে ঘোরানো হয়। এই পর্যায়ে লবণ, চুল ও মাংস ছাড়ানো হয়। এরপর ড্রাম থেকে বের করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করলে ভেজা এই চামড়ার রং নীল হয়ে যায়।
আগে বাংলাদেশের ওয়েট-ব্লু চামড়া ভারতে রপ্তানি হতো এখন তা চীনে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এর অর্থ হলো, আমরা আমাদের পরিবেশ দূষণ করে পণ্যটি চীনের কাছে বিক্রি করছি। তারা সেখানে এই ওয়েট-ব্লু চামড়া আরেকটু প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিশ্বমানের চামড়া উৎপাদন করছে।”
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্প অপরিকল্পিতভাবে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে হাজারীবাগে গড়ে ওঠে। ট্যানারি কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার ফলে নদী দূষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। পাশাপাশি কঠিন দূষিত বর্জ্য নদীতে ও নদীর পাড়ে ফেলে দেয়া হতো।
নদী বাঁচাতে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় পরিবেশবাদীদের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে সাভারের অদূরে হরিণধরায় ট্যানারি এস্টেট গড়ে তোলে সরকার। এই এস্টেটে বিভিন্ন কারখানাগুলোকে জমি দেয়া হয় এবং তাদের উৎপন্ন তরল পদার্থ নালার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ইটিপি-তে যায়। সেখান থেকে পরিশোধিত হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে যাওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
মাঝে মধ্যেই তরল বর্জ্য উপচে এস্টেটের রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে।
সংসদীয় কমিটি জানিয়েছে, চীনা কোম্পানি জিয়াংশু লিংঝি ইনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানি লি. এর কাছ থেকে সঠিক ইটিপি স্থাপন করিয়ে নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ. রাহমান একটি অনুষ্ঠানে ট্যানারি এস্টেটের ইটিপি সমস্যার জন্য জিয়াংশু লিংঝি ইনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানিকে দায়ী করেন।
এই ইটিপি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ইটিপি পরিচালনা করে চলে যায় কোম্পানিটি। এরপরই সেটির ত্রুটি ধরা পড়ে।