বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যক বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে মংলায়

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.12.09
ঢাকা
বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যক বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে মংলায় বিদুৎবিহীন অবস্থায় ওপর থেকে দেখা ঢাকা। ১ নভেম্বর ২০১৪।
[এএফপি]

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাটের মংলায় দেশের প্রথম বাণিজ্যক বায়ু বিদ্যুৎ​ প্রকল্প স্থাপনের কাজ পেল চীনা কোম্পানি, যদিও এই প্রকল্পের বাস্তবতা ও বিদ্যুতের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবনা অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানান মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। 

তিনি জানান, কনসোর্টিয়াম অব ইনভিশন এনার্জি (জিয়াংসু) কোম্পানি লিমিটেড, চায়না, এসকিউ ট্রেডিং অ্যাণ্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশ এবং ইনভিশন রিনিউয়েবল এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড হংকং যৌথভাবে ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। 

বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে এবং বিদুৎ উৎপাদন শুরু হলে তা বিদ্যুৎ বিভাগ কিনে নেবে বলে বেনারকে জানান বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, “উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০ বছর ধরে বিদ্যুৎ কিনবে সরকার। এতে ব্যয় হবে দুই হাজার ৩৫ কোটি টাকার বেশি,” যা প্রায় ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।

এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কোম্পানিগুলোকে কোনো সময় বেঁধে দেয়া হয়নি জানিয়ে সচিব বলেন, “তারা যত তাড়াতাড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তত তাড়াতাড়ি আমরা তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেব।”

“এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটিই হবে দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প,” বলেন সচিব হাবিবুর রহমান।

এদিকে প্রকল্পটি থেকে বাংলাদেশে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা বা ১৩ দশমিক দুই মার্কিন সেন্ট দরে প্রতি ইউনিট বিদুৎ কিনবে বলে জানান অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ।

তবে এই বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্ভাবনা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ম. তামিম।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না চীনারা কেন বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ও যৌক্তিকতা দেখছি না।”

“বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের তেমন সম্ভাবনা নেই। কারণ এখানে বাতাসের গতি দিনের মধ্যে, এমনকি ঘণ্টার মধ্যে পরিবর্তত হয়। বিদ্যুৎ বিভাগ এর আগে ফেনী ও চট্টগ্রামে দুটি ক্ষুদ্র বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়,” বলেন ম. তামিম।

এছাড়া প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১০ দশমিক ৫৬ টাকা বা ১৩ সেন্ট “অনেক বেশি” মন্তব্য করে অধ্যাপক তামিম বলেন, “সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, প্রতি ইউনিট বায়ু বিদ্যুতের মূল্য আট মার্কিন সেন্ট অতিক্রম করলে সেই প্রকল্প আর অর্থনৈতিকভাবে চলনসই থাকে না।” 

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা প্রকল্পগুলো মূলত চীনা বিনিয়োগে স্থাপিত। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে চীনা কোম্পানির সাথে চুক্তি ​করেছে সরকার।

ঢাকা শহরে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজও পেয়েছে একটি চীনা কোম্পানি। তবে এই প্রথমবারের মতো বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ গেলো চীনা কোম্পানির কাছে। 

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি

বাংলাদেশে বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কমপক্ষে ২১ হাজার মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াট বলে বেনারকে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের জনসংযোগ শাখার পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী। 

তিনি বলেন, “২০০৯ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ২০২০ সালের মধ্যে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে তার শতকরা ১০ ভাগ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে।” 

তবে সরকারের সেই লক্ষ্য পুরণ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে মাত্র ৩৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।

“সে কারণে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার,” বলেন সাইফুল হাসান চৌধুরী।

বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও নতুন প্রকল্পের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বেনারকে বলেন, সাধারণত প্রকৃত চাহিদার চেয়ে শতকরা ২৫ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা “হাতে সংরক্ষণ করতে হয়।”

“কারণ একইসাথে সকল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎ​পাদনে থাকবে না। কোনোটি নষ্ট থাকবে, আবার কোনোটি রক্ষণাবেক্ষণে থাকবে” জানিয়ে তিনি বলেন “সে কারণে আমাদের চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি।” 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হলে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা আরো বাড়বে বলেও জানান মোহাম্মদ হোসেন।

সরকার বর্তমানে কোনো লক্ষ্যবর্ষ উল্লেখ না করে মোট উৎপাদনের ১০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎ​পাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে জানান তিনি। 

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব আনু মুহাম্মদ মনে করেন, দুর্নীতির কারণে বিদ্যুৎ খাতে ‘বেহাল অবস্থা’ চলছে।

“বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে কোনো স্বচ্ছতা নেই,” মন্তব্য করে তিনি বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় অথবা এর আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান কারো কাছে জবাবদিহি নয়। কাজেই বিদ্যুৎখাতে আমরা স্বচ্ছতার অভাব দেখি।”

“সরকার চীনা ও অন্যান্য কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। কারণ জনশ্রুতি আছে কাজ পেতে এসব কোম্পানি ক্ষমতাবান রাজনীতবিদ ও আমলাদের কমিশন দেয়,” বলেন আনু মুহাম্মদ।

তাঁর মতে “এই সকল কাজের কারণে জনগণ কঠিন মূল্য দিচ্ছে। আর কোম্পানিগুলো আমাদের টাকা নিয়ে যাচ্ছে।”

তবে বিদুৎ খাতে জবাবদিহিতা নেই; এটি একটি ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ’ বলে মন্তব্য করেন সচিব হাবিবুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।