সর্বশেষ সংযোগ স্থাপন, দৃশ্যমান হলো পূর্ণ পদ্মা সেতু
2020.12.10
ঢাকা

অবশেষে পূর্ণ অবয়ব পেয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ নির্মাণাধীন অবকাঠামো পদ্মা সেতু। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ স্প্যান বা সংযোগ কাঠামো স্থাপনের মধ্য দিয়ে ছয় কিলোমিটারের বেশি এই সেতুর পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়।
এখন সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলেই ব্যবহারের জন্য এই বহুমুখি সেতু খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার “দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মার দুই পাড় সংযুক্ত হলো,” বেনারকে জানান পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের।
দ্বিতল এই সেতুটিকে যান চলাচলের উপযোগী করতে এখনো ঢালাই, সংযোগ সড়ক, ভায়াডাক্ট বা খিলানযুক্ত সংযোগ সেতু ও রেল লাইন বসানোর কাজ বাকি রয়েছে বলে জানান তিনি।
পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বা দুই খুঁটির মধ্যবর্তী সংযোগ কাঠামো বসে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সর্বশেষটি বসল বৃহস্পতিবার।
সেতুটি আগামী এক বছরের মধ্যেই চালু করা যাবে বলে বৃহস্পতিবার আশা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আলাদা করে রেখেছে পদ্মা নদী।
স্বাধীনতার পর থেকে সকল সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বললেও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে কাজটি করার উদ্যোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। এই প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক।
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করলে নিজস্ব অর্থায়নে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
নদী শাসনের কাজ দেয়া হয় সিনোহাইড্রোকে এবং মূল সেতু নির্মাণের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে। মূল সেতু নির্মাণের খরচ ধরা হয়েছে তিন দশমিক ৮৬৮ বিলিয়ন ডলার।
এই সেতুতে রেল সংযোগেরও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। রেল প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনা সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। রেল প্রকল্পের মোট চার দশমিক ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের শতকরা ৮৫ ভাগ আসবে চীনা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের মাধ্যমে।
স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণ
পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সেতুটি স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে। সেতুর মূল কাঠামো বা স্প্যান স্টিলের তৈরি। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য দেড়শ মিটার। সেতুর ৪২টি খুঁটি এবং যানবাহন চলাচলের পথ কংক্রিটের।
পদ্মার সেতুর মূল অংশ অর্থাৎ নদীর ওপরের অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার হলেও দুই পারে আরও প্রায় চার কিলোমিটার খিলানযুক্ত সংযোগ সেতু আগেই নির্মাণ হয়ে গেছে। এই অংশে স্টিলের কোনো স্প্যান নেই।
সেতুটির ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ২০টি জাজিরা প্রান্তে, ২০টি মাওয়া আর একটি মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের ঠিক মাঝখানে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের।
প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, সেতুটিতে চার লেনের ২২ মিটার প্রশস্ত চারটি পথ থাকবে। স্টিলের স্প্যানের ওপর পথ তৈরির জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। এর উপরে পিচঢালাই করা হবে।
মুল সেতুর নিচে স্প্যানের ভেতর দিয়ে এক লাইনে ট্রেন চলবে। ওই এক লাইনেই মিটারগেজ ও ব্রডগেজ; দুই ধরনের ট্রেন চলাচলেরই ব্যবস্থা থাকবে। ভায়াডাক্ট বা খিলানযুক্ত সংযোগ সেতুতে এসে যানবাহন ও ট্রেনের পথ আলাদা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অর্থনীতির গতি বাড়াবে
এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। একইসাথে সড়ক পথে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি যোগাযোগের পথ তৈরি হবে। এতে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
“যোগাযোগ হলো পৃথিবীর উন্নয়নের বাহন,” মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বেনারকে বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হলে পদ্মার দুপাশের জেলাগুলোর সাথে যোগাযোগ উন্নত হবে।”
তাঁর মতে, সেতু নির্মাণ শেষ হলে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনে সময় এবং খরচ কমার ফলে, “অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।”
এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন নতুন কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সৃষ্টি হবে বলেও মনে করেন ফাহমিদা খাতুন।
সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানো দেখতে হাজির হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের পৌর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ সাদী। তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বেনারকে বলেন, “পদ্মার দুপাশের জেলাগুলোর যোগাযোগে দীর্ঘদিন যে বাধা ছিল, এই সেতুর মাধ্যমে সেটি খুলে গেলো।”
এর আগে যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
রেল সংযোগের ত্রুটি সংশোধন
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের নকশায় চিহ্নিত ত্রুটি সংশোধন হয়েছে বলে জানিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম।
তিনি বেনারকে বলেন, “রেল প্রকল্পে যে ত্রুটি ধরা পড়েছিল সেটা ঠিক হয়ে গেছে।”
গত ১৬ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের পরিচালককে (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেখা এক চিঠিতে শফিকুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতু সংযোগ সড়কের কিছু অংশ কেটে পাইল ও পাইলক্যাপ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ওই অংশটিতে যানবাহনের নিরাপদ চলাচল ‘মারাত্মকভাবে’ ব্যহত হবে।
এ ছাড়াও রেল সংযোগের জন্য পিয়ারগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে, সংযোগ সড়কের নিচের স্তর থেকে যানবাহন মূল সেতুর দোতলায় উঠতে গেলে সম্মুখ অংশ আটকে যেতে পারে।
তবে গত ২ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সাংবাদিকদের বলেন, “রেল প্রকল্পে ডিজাইনের কোনো সমস্যা নেই। সেতু প্রকল্পের সাথে সমন্বয়ে যে রিকয়ারমেন্ট ধরে আমরা কাজ করছিলাম সেটি কিছুটা সংশোধন হয়েছে।”
যেদিন পদ্মা সেতুর সড়কপথ উদ্বোধন হবে সে সেদিনই রেলপথ চালু করার আশা ব্যক্ত করে রেলমন্ত্রী বলেন, “যদিও আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত তবু অন্তত ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাতে রেল চালু করতে পারি সে বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছি।”