চীনাদের অনলাইন প্রতারণায় অন-অ্যারাইভাল ভিসায় কড়াকড়ি
2023.08.21
ঢাকা

অন-অ্যারাইভাল ভিসার সুযোগ নিয়ে পেশাজীবী হিসেবে বাংলাদেশে এসে অনলাইন প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার অভিযোগ উঠেছে চীনা নাগরিকদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে যোগসাজশে চীনা নাগরিকরা অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ।
প্রতারণার অভিযোগে ইতোমধ্যে সাতজন চীনা নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব অ্যাপ পরিচালনাকারী চীন অথবা অন্য কোনো দেশে অবস্থান করায় তাদের ধরা যায় না।
এমন প্রেক্ষাপটে অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা বজায় রাখলেও চীনা নাগরিকদের ভিসা প্রদানের আগে তাঁদের কাগজপত্র বিস্তারিত পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে সোমবার বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন।
তিনি বলেন, “আগে চীনা নাগরিকদের ক্ষেত্রে নামমাত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হতো। কিন্তু বিভিন্ন অনলাইন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্য তাঁদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসার শর্ত কঠিন করা হয়েছে।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “বর্তমানে চীনা নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার আগে তাঁর প্রকৃত পেশার প্রমাণপত্র, ওয়ার্ক পারমিট, হোটেল বুকিং, কোন কোম্পানিতে কাজ করবেন, ইত্যাদি যাচাই করে তবে ভিসা দেয় পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।”
ফারুক হোসেন বলেন, “দেশের বিভিন্ন থানায় দায়ের করা অনলাইন প্রতারণার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চীনা নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশ এবং বিভিন্ন মামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক আটক হয়েছেন।”
চীনারা কী ধরনের প্রতারণা করেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তিন বাংলাদেশির সহায়তায় চীনের কয়েকজন নাগরিক এমএলএম নামে একটি অ্যাপ বানিয়ে অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে, এক লাখ টাকা জমা রাখলে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা লাভ দেওয়া হবে। এই প্রলোভনে সবাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।”
“প্রথম প্রথম তারা গ্রাহকদের লাভ দেয়। লাভ নিয়ে বিশ্বাস তৈরি হওয়ার পর যখন সবাই তাদের টাকা জমা করে এবং টাকার পরিমাণ অনেক হয়ে যায় তখন এক রাতে হঠাৎ অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়। বিকাশ, নগদ, রকেটসহ বিভিন্ন আর্থিক অ্যাপ দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়,” বলেন তিনি।
ফারুক হোসেন বলেন, “এই অ্যাপের পরিচালনাকারী অ্যাডমিন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে স্থানীয়দের আমরা ধরে ফেলব।”

চীনাদের প্রতারণার নমুনা
বেনারের হাতে আসা ধানমন্ডি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে এসআই শিবেন্দ্র ঢালী জানিয়েছেন, পুলিশ চীনা নাগরিক চেন ওয়েনচং ওরফে কেভিন চেন-এর কোম্পানি থান্ডার লাইট টেকনোলজি লিমিটেড কর্তৃক পরিচালিত অ্যাপ টিকালা পারসোনাল লোনস লিমিটেড (টিকালা ০৪৩০) ও ক্যাশম্যান (ক্যাশম্যান-০৩২৬) এর মাধ্যমে প্রতারণার দায়ে পাঁচ বাংলাদেশিকে আটক করেছে।
তাঁরা হলেন—ইমানুয়েল এডোয়ার্ড গোমেজ (৩১), আরিফুজ্জামান (২২), শাহিনুর আলম ওরফে রাজীব (৩২), শুভ গোমেজ (২৩) ও মো. আকরাম আলী (৪৬)। অ্যাডমিন চেন ওয়াং চীনে অবস্থান করছেন। অ্যাপ দু’টির সার্ভার চীনে এবং সেখান থেকেই সেগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই দু’টি অ্যাপ ছাড়াও র্যাপিডক্যাশ-কুইক অনলাইন ই-লোন, আমারক্যাশ-পারসোনাল লোনস অনলাইন, ক্যাশ-ক্যাশ-ফাস্ট লোনস অনলাইন এবং ক্যাশক্যাশ অ্যাপগুলোর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো জামানতহীন অনলাইন তাৎক্ষণিক লোনের চটকদার অফার সংবলিত বিজ্ঞাপনসমূহ বুস্টিংয়ের মাধ্যমে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অ্যাপগুলো ডাউনলোড করার জন্য আকৃষ্ট করে।
এই অ্যাপগুলো ডাউনলোড করার সময় গ্রাহকের কাছে বিভিন্ন ধরনের অনুমতি চাওয়া হয়। এরপর ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত হারে সুদের বিপরীতে ঋণ গ্রহণে বাধ্য করে এবং অবৈধ সুদের ব্যবসা পরিচালনা করে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেয়।
এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে ইমেইল পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা পর্যন্ত কোনো জবাব মেলেনি।
অনলাইন প্রতারণার শিকার হয়ে কাফরুল থানায় মামলা দায়ের করেছেন সোহেলী সুলতানা। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, গত বছর ২৯ অক্টোবর তাঁর মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ইংরেজি মেসেজ আসে। সেখানে তাঁর জন্য ১০ থেকে ২০ মিনিটের একটি খণ্ডকালীন চাকরির অফার ছিল। প্রতিদিনের বেতন বলা হয়, আট হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা।
এই প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা একটি লিংকের মাধ্যমে নিজেকে কোম্পানিতে নিবন্ধন করার পরামর্শ দেন। ওই কোম্পানির নাম www.ryyntuss.com। নিবন্ধনের পর তারা তাঁকে টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে বলে এবং তিনি তাদের কথা মতো ওই অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর তাঁকে অনলাইনে পণ্য বিক্রির কথা বলা হয়।
সোহেলী সুলতানা সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রথমে আমাকে চশমা বিক্রি করতে দেয়, আমি বিক্রি করি। বিক্রির পর আমাকে লাভ দেয়। এতে আমার আস্থা বেড়ে যায়। এভাবে আমি কয়েক দফায় পণ্য বিক্রি করেছি। আমি তাদেরকে বিকাশের মাধ্যমে ৭০ হাজার টাকা প্রদান করি।”
তিনি বলেন, “এরপর তারা আমাকে ৮৭ হাজার ৫৫০ টাকা মূল্যের কার্পেট কেনার কথা বলে। আমি যদি সেই কার্পেট না কিনি তাহলে তারা আমার অ্যাকাউন্টের টাকা ফেরত দেবে না বলে জানায়। তখন আমার সন্দেহ হয়। জানতে পারি এরা সংঘবদ্ধ চক্র।”
“আমি টিউশনি করে জীবন চালাই এবং চাকরি খুঁজছি। আমি খণ্ডকালীন চাকরির কথায় আশাবাদী হয়েছিলাম। ওই ৭০ হাজার টাকার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা আমার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ধার করেছি। ওরা এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যে আমি আমার সব জমানো টাকা ওদের দিয়ে দিই,” বলেন সোহেলী।
তিনি আরো জানান, “আমি মামলা করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ আমার টাকা উদ্ধার করে দিতে পারেনি। আবার আসামি ধরেছে কি না তাও জানি না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনা কোম্পানি কাজ পাওয়ায় বেশিসংখ্যক চীনা শ্রমিকসহ পেশাজীবীরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন।
পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে হাজার হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। বাংলাদেশে কত সংখ্যক চীনা নাগরিক রয়েছে সে বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে না সরকার। তবে অভিবাসন পুলিশের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক অবস্থান করছেন।