৪০ লাখ ইজিবাইক বন্ধের আদেশ দিলো আদালত
2021.12.15
ঢাকা

চীন থেকে আমদানি করা এসিড-ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহন আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে সরকারকে আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
ইজিবাইক ও টমটম হিসাবে পরিচিত বাহনগুলো বন্ধের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার কাজী জসিমুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর রিট আবেদন নিষ্পত্তি করতে গিয়ে এই আদেশ দেয় বিচারপতি মামনুন রহমান এবং খন্দকার দিলিরুজ্জামান সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
বিআরটিএ বলছে, আদালতের আদেশ হাতে পেলে সরকারের নির্দেশ মোতাবেক এগুলো বন্ধ করতে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
পরিবেশবাদীরা আদালতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও চালকরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে এই বাহনগুলো রাতারাতি নিষিদ্ধ করা হলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।
‘সিসা দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক’
রিটকারী কাজী জসিমুল ইসলামের আইনজীবী আতিক তৌহিদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, “আজ আদালত সারা দেশে অবৈধভাবে চলাচলকারী ৪০ লাখ এসিড-ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহন আমদানি এবং চলাচল নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে আদেশ দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “এসিড ব্যাটারি চালিত এই বাহনগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয় এবং এগুলোর মাধ্যমে প্রতি বছর সারা দেশে লাখ লাখ এসিড-সিসাযুক্ত ব্যাটারি পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয় এবং সিসা দূষণ হয়। এগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। সে কারণে আদালত এগুলো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন।”
“এসিড-ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহন চার্জ করার জন্য চোরাইভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়। চার্জ করতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় হয় তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই,” বলেন আইনজীবী আতিক।
বাংলাদেশে এসিড-ব্যাটারি চালিত তিন চাকার বাহনগুলো “পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি, এতে কোনো সন্দেহ নেই,” বুধবার বেনারকে বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক।
বাংলাদেশে এই এসিড চালিত ব্যাটারিগুলো “বিজ্ঞানসম্মত ও নিরাপদ উপায়ে রিসাইকেল করা হয় না,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন অনিরাপদ স্থানে ভেঙ্গে পোড়ানো হয়। এই সকল পুরাতন ব্যাটারির এসিডকে চুন দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা গেলেও এর ভেতরের ভারি ধাতু সিসা পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হয়।”
“সিসা দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। এগুলো মাটি, পানি, বাতাস দূষণ করে এবং পরিশেষে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে,” বলেন পরিচালক জিয়াউল হক।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইনভায়রেনমন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির (ইপিএ) তথ্য অনুসারে, সিসা দূষণের কারণে মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের স্নায়ুবিক সমস্যা হয়।
২০২০ সালের জুলাই মাসে শিশুদের মধ্যে সিসা দূষণের প্রভাব নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাবিশ্বে ৮০ কোটি শিশু সিসা দূষণের শিকার। সিসা দূষণে আক্রান্ত শিশুদের প্রায় অর্ধেক বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশুদের শরীরে সিসা দূষণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশে তিন কোটি ৫৫ লাখ শিশু সিসা দূষণের শিকার।
শিশুদের মাঝে সিসা দূষণের উচ্চহারের কারণ, ব্যাটারি রিসাইক্লিংয়ের কাজে সস্তা অথবা বিনা শ্রমে শিশুদের কাজে লাগিয়ে পুরাতন ব্যাটারি ভাঙ্গা ও পোড়ানো হয়।
বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ
বিআরটিএ’র পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা আদালতের আদেশ এখনও হাতে পাইনি। আদেশ হাতে পৌঁছালে সেই মোতাবেক আলোচনা সাপেক্ষে সেটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “তবে এই আদেশ বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ, গ্রামেগঞ্জে লাখ লাখ মানুষ এই ইজিকবাইক এবং মোটরচালিত রিকশার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, আদেশটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের অনেক দিক ভেবে কাজ করতে হবে।”
সিসা দূষণ রোধে এসিড ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশকে “পরিবেশ রক্ষার দিক থেকে অনেক বড়ো সিদ্ধান্ত,” বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হাফিজুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “সিসা দূষণ আমাদের দেশে যে ক্ষতি সাধন করছে সেটি আমরা কখনো বুঝতে পারছি না। ভবিষ্যতে এই দূষণের পরিণতি হবে মারাত্মক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই দূষণের মূল শিকার হবে।”
“ভবিষ্যতে দেখা যাবে শিশুদের স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, ভূমিষ্ঠ সন্তানগুলো বিকলাঙ্গ হবে,” বলেন অধ্যাপক হাফিজুর রহমান।
তবে তাঁর মতে, “এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে ধীরে ধীরে করতে হবে।”
তিনি বলেন, “২০০১ সালে তখনকার সরকার রাতারাতি পলিথিন বন্ধ করে দেয়। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। যদি একটি সঠিক পরিকল্পনা না নিয়ে এটি বন্ধ করতে যাওয়া হয় তবে এই আদেশ বাস্তবায়ন করা যাবে না।”
মিরপুরে দুয়ারিপাড়া এলাকায় ইজিবাইক মেরামত করেন মো. মোস্তফা। তিনি বেনারকে বলেন, “ইজিবাইক অসংখ্য দরিদ্র বেকার মানুষের কর্মসংস্থান করছে। গাড়ির অবস্থা অনুযায়ী ৬০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকায় একটি ব্যাটারি চালিত গাড়ি পাওয়া যায়। সেটি চালিয়ে দিনে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করে চালক।”
মোস্তফা বলেন, “এগুলো পরিবেশের জন্য খারাপ আমরা সবাই জানি। ব্যাটারি খুব ক্ষতিকর। কিন্তু মানুষের আসলে কিছু করার নেই। এই গাড়িগুলো থাকার কারণে দেশে অপরাধ কমে গেছে। গাড়ি বন্ধ করলে দেখবেন এই বেকার লোকগুলো অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে পড়বে।”
“আবার একজন মানুষ অল্প খরচে কম সময়ে পৌঁছাতে পারে। সেকারণে মানুষও এগুলো বন্ধ হোক তা চায় না,” বলেন মোস্তফা।