মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দিতে বাংলাদেশকে চীনের বার্তা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.06.03
ঢাকা
মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দিতে বাংলাদেশকে চীনের বার্তা ওয়াশিংটন ডিসির জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীন সম্পর্কিত মার্কিন নীতি বিষয়ে আলোচনায় বক্তব্য রাখছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ২৬ মে ২০২২।
[এএফপি]

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নতুন চীনা কৌশল ঘোষণার সপ্তাহখানেকের মাথায় বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোকে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন সামরিক ও অর্থনৈতিক জোটে যোগ না দিতে বার্তা দিয়েছে বেইজিং।

বুধবার চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামান ও চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক লিউ জিনসংয়ের বৈঠকের পর দেয়া এক চীনা বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যেন স্নায়ুযুদ্ধ ও ব্লক রাজনীতির মানসিকতা বাদ দিয়ে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করে।

গত ২৬ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর সরকারের নয়া চীনা কৌশল ঘোষণা করেন। ওই কৌশলে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করবে, যুক্ত হবে এবং চীনের সাথে প্রতিযোগিতা করবে।

বৃহস্পতিবার চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বৈঠকের ছবিসহ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়।

বিবৃতিতে প্রধানত অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানকে সাথে নিয়ে মার্কিন জোট কোয়াড, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও আমেরিকার সমন্বয়ে গঠিত অকাস (Aukus) জোট এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।

তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি প্রকৃতপক্ষে চীনা সরকারের অবস্থান, বাংলাদেশের নয়।

বৃহস্পতিবার চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, পহেলা জুন চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব উজ জামানের সাথে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক লিউ জিনসং এর বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও গভীর আলোচনা হয়।

এতে বলা হয়, চীনা মহাপরিচালক বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে জানান, মার্কিন সরকারের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, অকাস, কোয়াড গ্রুপিং এবং সাম্প্রতিক ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মকাঠামো খাটো হবে এবং “ব্লক সংঘর্ষ” বৃদ্ধি পাবে।

“চীন মনে করে যে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ও অঞ্চলের মৌলিক স্বার্থকে মনে রাখবে, স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে, শীতলযুদ্ধ ও ব্লক রাজনীতির মানসিকতা পরিহার করবে, সত্যিকারের বহুপাক্ষিকতা বজায় রাখবে এবং এই অঞ্চলের কষ্টার্জিত শান্তি ও উন্নয়নের পরিবেশ রক্ষা করবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।

জাতীয় স্বার্থ ও শান্তিকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে সে ব্যাপারে “চীন কী বলল, অথবা আমেরিকা কি বলল সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই,” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান।

“জাতীয় স্বার্থ ও শান্তিকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতির আলোকে আমরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেব,” জানিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো, “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সকল ধরনের সামরিক জোট থেকে বিরত থাকে। কারণ আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যুদ্ধ কারও জন্য সুফল বয়ে আনে না। সেকারণে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তির পক্ষে।”

এদিকে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক বিষয়ে দেয়া বিবৃতিটি “সম্পূর্ণ চীনা সরকারের বিবৃতি” আখ্যায়িত করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সেখানে কোয়াড ও ইন্দো-প্যাসিফিক জোট ও আমেরিকার ব্যাপারে চীনা সরকারের অবস্থান প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই অবস্থানের সাথে একমত নয়।”

চীন চায় না বাংলাদেশ কোয়াড অথবা ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগদান করুক জানিয়ে তিনি বলেন, “এর আগেও কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত।”

বাংলাদেশের কাছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।

“চীন আমাদের বৃহৎ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড়ো বাজার,” মন্তব্য করে তিনি বলেন “বাংলাদেশের উচিত স্বাধীনভাবে তার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।”

দক্ষিণ চীন সাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা প্রভাব মোকাবেলায় আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত ও জাপানকে নিয়ে গঠিত হয় সামরিক জোট কোয়াড। একইসাথে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনকে সাথে নিয়ে ত্রিদেশীয় অকাস গঠন করেছে মার্কিন সরকার। গঠিত হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক।

চীনে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ শুক্রবার বেনারকে বলেন, “চীন মনে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাম্প্রতিক চীনা নীতির প্রেক্ষাপটে তাদের এই ধারণা হতেই পারে।”

“খোলামেলাভাবে বলতে গেলে, চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠেকাতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকার এই চাপ বিভিন্নভাবে সামলাতে চেষ্টা করছে,” বলেন মুনশি ফায়েজ।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মতে, “বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে গঠিত সামরিক জোটে যোগদান করবে না। তবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগ দেয়াতে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা আমি দেখি না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।