চীনের বিপরীতে উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ

বেনার স্টাফ
2021.06.23
ব্যাংকক, ঢাকা, জাকার্তা, কুয়ালালামপুর ও ম্যানিলা
চীনের বিপরীতে উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইংল্যান্ডে জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের শেষে কর্নওয়াল বিমানবন্দর নিউকয়েতে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। ১৩ জুন ২০২১
[রয়টার্স]

চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের বিপরীতে গ্রুপ-৭ নামে পরিচিত বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। দেশগুলোর মতে, নতুন এই উদ্যোগের ফলে তাদের ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাহিদায় অর্থায়নের নতুন একটি উৎস তৈরি হবে। 

তবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড পার্টনারশিপ (বি-৩ ডাব্লু) নামের নতুন এই উদ্যোগের আওতায় কখন এবং কীভাবে বিনিয়োগ হবে তা এখনো পরিষ্কার না হওয়ায় বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগটি চীনের চলমান প্রকল্পের সঙ্গে কতটা তাল মেলাতে পারবে তা দেখতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। 

কারণ, চীনের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ৮ বছর আগে, যার আওতায় বৈশ্বিক অবকাঠামো-নির্মাণ কর্মসূচিতে ইতোমধ্যে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়ে গেছে। 

সম্প্রতি ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে জি-৭ দেশগুলো আগামীতে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে কয়েকশো বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। জি-৭ দেশগুলো হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল স্বীকৃত বিশ্বের সাতটি উন্নত অর্থনীতির দেশ; জাপান, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন উদ্যোগের ঘোষণায় বলেছেন এই কর্মসূচি উন্নয়নশীল বিশ্বের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে।

উদ্যোগটিকে “আমাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ,” বলে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান।

“আমরা আমাদের উন্নয়নের প্রচেষ্টায় এই সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। এর ফলে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীনা উৎসের বাইরেও তহবিল সন্ধানের সুযোগ পাব," বেনারকে বলেন মন্ত্রী।

“অর্থ সংগ্রহের বিকল্প উৎস,” হিসেবে জি-৭ এর এই নতুন উদ্যোগ “উন্নয়নশীল এবং স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি বড়ো সুযোগ” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। 

জি ৭-এর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া। তবে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার কর্মকর্তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

“নতুন এই উদ্যোগ এবং চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড (ওবিওআর) উদ্যোগ উভয়ই মিলিতভাবে আমাদের শক্তিশালী করবে,” বেনারকে বলেন থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র থানি সেঙগ্রাথ।

উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র হ্যারি রোক বেনারকে বলেন, “তবে এখনো এটি দেখার ও বাস্তবে রূপ নেওয়ার বিষয়।”

উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে ইন্দোনেশিয়ার মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জডি মাহারদি বেনারকে বলেন, “এখন আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নেয়া আগের এরকম অনেক উদ্যোগই বাস্তবায়ন সংকটে রয়েছে।”

“তবে উদ্যোগটি শুধু পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে ভালো ক্ষেত্রগুলোর জন্য না হয়ে ‘সহযোগী’ দেশগুলোর প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো নমনীয় হতে হবে। আমি ‘সহযোগী’ কথাটা এই কারণে ব্যবহার করেছি যে আমরা এক্ষেত্রে শুধু দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক চাই না,” বলেন জডি মাহারদি।

ইন্দোনেশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেক্সট পলিসির নির্বাহী পরিচালক ফিথ্রা ফয়সাল হাসতিয়াদির মতে বি-৩ ডাব্লু এখনো “পুরোপুরি দৃশ্যমান না হলেও তাত্ত্বিকভাবে ইন্দোনেশিয়ার জন্য এটি একটি ভালো তহবিলের উৎস।”

সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ওহ এই সান এর মতে, “বি-৩ ডাব্লু এই অঞ্চলের দেশগুলোকে উভয় দিকে খেলার সুযোগ দেবে। কে বেশি ভালো প্রস্তাব দেয় তা দেখার সুযোগ পাবে দেশগুলো।" 

ওবিওআর ২০১৩ সালে শুরু হওয়া চীনের রাষ্ট্রপতি সি জিনপিংয়ের একটি ভূ-রাজনৈতিক কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরেও বাজারগুলোর সঙ্গে চীনের সংযোগ স্থাপনের জন্য বন্দর, সড়ক ও রেলপথের একটি নেটওয়ার্ক গড়ার মাধ্যমে আধুনিককালের একটি সিল্ক রোড স্থাপন।

আট বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের আওতায় বিশ্বজুড়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানী, অবকাঠামো এবং যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করছে চীন।

লন্ডন ভিত্তিক অর্থনৈতিক তথ্য সংস্থা রেফিনিটিভের মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি নাগাদ ওবিওআরের আওতায় প্রায় ৩ হাজার প্রকল্পে ৩.৮৭ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলমান কাজের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় ৬ বিলিয়ন ডলার বানডুং-জাকার্তা উচ্চ গতির রেল প্রকল্প এবং মিয়ানমারে ১.৩ বিলিয়ন ডলার কিউকফিউ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণসহ বহু প্রকল্প।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬’র অক্টোবর থেকে চীন বাংলাদেশের নয়টি প্রকল্পে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে। যদিও বাংলাদেশে এগুলোকে ওবিওআরের প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে না। 

‘অধিকতর ন্যায়সঙ্গত পন্থা’

কেউ কেউ বি-৩ডব্লিউ এবং ওবিওরকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখলেও যুক্তরাষ্ট্র তথা জি-৭ দুটি উদ্যোগকে ‘মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র’ বলে ব্যাখ্যা করেছে।

“আমরা মনে করি যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রয়োজনের মেটাতে আরও অনেক ন্যায়সঙ্গত উপায় রয়েছে,” ১৩ ই জুন কর্নওয়ালে সংবাদ সম্মেলনে বলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। 

তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি এটি কেবল সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্যই মঙ্গলজনক হবে না, এটি পুরো বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হবে।”

চীনের অগণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বিভিন্ন দেশকে ঋণের ফাঁদে বন্দি করার কৌশলের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, “এটি গণতান্ত্রিক দেশগুলোর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বশীল, কোনো মূল্যবোধহীন স্বৈরশাসকের প্রতিনিধিত্বশীল উদ্যোগ এটি নয়।”

চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতার বার্তা হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া একটি ঋণ প্রকল্পের কথা বলে থাকেন বিশ্লেষকরা। দেশটি ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হওয়ায় ২০১৪ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি সংস্থা শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ হাম্বানটোটা বন্দরে সিংহভাগ মালিকানা নিয়ে নেয়। বিশ্বজুড়ে মারাত্মক পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্পগুলোতে চীন অর্থায়ন করার কারণেও সমালোচিত। 

পরিবেশবিদরা সম্প্রতি বলেছিলেন, চীন তাদের নিজ দেশে যে পরিমাণ অনুমতি দেয় তার চেয়ে যথাক্রমে পাঁচগুণ এবং তিনগুণ বেশি নাইট্রোজেনের সালফার ডাই অক্সাইড এবং অক্সাইড নির্গত করবে, বাংলাদেশে এমন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করছে।

অন্যদিকে ১৩ জুন যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে জি-৭ বলেছে, “প্রকল্প পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, সামাজিক ও পরিবেশগত সুরক্ষা এবং বিশ্লেষণাত্মক সক্ষমতা অর্জনের জন্য সর্বোত্তম মানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা স্বচ্ছতা, উন্মুক্ততা, ন্যায্যতা, অর্থনৈতিক কার্যকরতা, স্থায়িত্ব এবং প্রতিযোগিতামূলক মানের উপর জোর দিয়েছি। আন্তর্জাতিক বিধি ও মান মেনে চলার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছি।” 

প্রয়োজনীয় তহবিল নিয়ে সংশয়

হোয়াইট হাউসের ফ্যাক্টশিটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বি-৩ ডাব্লু’র অগ্রাধিকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো হবে জলবায়ু, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং লিঙ্গ সমতা এবং সাম্য।

সিঙ্গাপুর ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ফেলো ওহ এর মতে, “উন্নত উদার গণতন্ত্রগুলোর দৃষ্টিতে এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হলেও অন্য অনেক দেশে এগুলো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় না।”

“এছাড়া জি-৭ স্বচ্ছতার উপর জোর দিচ্ছে, যা এখনো উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে আদর্শ নয়,” বেনারকে বলেন ওহ।

জি-৭ দেশগুলো চীনের বিশাল ওবিওআর বিনিয়োগের জায়গায় ভাগ বসাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন ওহ এবং ইন্দোনেশিয়ান অর্থনীতিবিদ ফিথ্রা।

“জি-৭ দেশগুলোর এখন ইচ্ছে মতো ওড়ানোর টাকা নেই। মহামারিতে দীর্ঘদিনের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে,” বলেন ওহ।

ফিথ্রা’র মতে, “মহামারি এবং ব্রেক্সিটের প্রভাব থেকে মুক্তি পাবার পর বিশ্বজুড়ে অবকাঠামোগত বিনিয়োগও প্রয়োজন- এটা নিজ দেশের নাগরিকদের বোঝাতে জি-৭ ভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোকে সমস্যা পোহাতে হবে।”

“তাদের এই উদ্যোগের জন্য টাকাটা কোথা থেকে আসবে? তাদের নিজস্ব জনগণের বিরোধিতাও থাকবে এতে,” বলেন ফিথ্রা।

“ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বি-৩ ডাব্লু খুব দেরিতে এসেছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সাফেচার এবি’র মালয়েশিয়া শাখার সিনিয়র রাজনৈতিক ও সুরক্ষা ঝুঁকি বিশ্লেষক চ্যান হোই চিয়াং।

তাঁর মতে, “বি-৩ ডাব্লু যদি এশীয় দেশগুলোর মন জয় করতে চায় তবে এর জন্য তাদের অনেক কসরত করতে হবে।” 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন: থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ননতারাত ফাইচারয়েন, চিয়াং মাই থেকে কুনাওয়ুত বুনেরিয়াক, ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী, জাকার্তা থেকে আহমাদ শ্যামসুদিন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে হাদি আজমি এবং কোটা কিনাবালু থেকে কেন চ্যাং এবং ম্যানিলা থেকে মেরিলি লুসেনিও।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।