হঠাৎ কলেরার প্রাদুর্ভাব, চিন্তিত জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা
2022.04.22
ঢাকা

বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার দেশে কলেরা নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করে আসলেও হঠাৎ কলেরার প্রাদুর্ভাব কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পর্যবেক্ষণ মতে, বর্তমানে ডায়রিয়া আক্রান্তদের ২০ ভাগেরও বেশি রোগী কলেরায় আক্রান্ত।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত এলাকায় কলেরার টিকা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
শুক্রবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, “মে মাসে কলেরার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেসব এলাকায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব এলাকায় কলেরার টিকা দেওয়া হবে। সামনে এ টিকার পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।”
রাজধানীর মহাখালী এলাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি জানান, কলেরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে ঢাকা শহরে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে দেখা যায়। পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জেলায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে শুরু করে বলে জানায় সরকারের হেলথ কন্ট্রোল রুম।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ বছর দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এসময় তিনি বলেন, ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোতে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি।
তবে আইসিডিডিআর,বি বলছে, ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের।
এ প্রসঙ্গে নাজমুল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের কাছে এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই তথ্য হস্তান্তর করেনি আইসিডিডিআর,বি। করলে আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো।”
আইসিডিডিআর,বির তথ্য মতে, গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে ডায়রিয়া আক্রান্তদের মধ্যে কলেরায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ ভাগের মধ্যে নিয়মিত ওঠানামা করছে।
মে মাসে প্রথম ও জুন মাসে দ্বিতীয় ডোজ টিকা
কলেরা টিকা কীভাবে দেয়া হবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল বেনারকে বলেন, এক বছর বয়স থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সব বয়সীরা কলেরার টিকা পাবেন। তবে গর্ভবতী নারীরা টিকার আওতার বাইরে থাকবেন।
তিনি জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং সবুজবাগ এলাকাকে কলেরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মে মাসে টিকার প্রথম ডোজ এবং জুন মাসে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। টিকার জন্য কোনো রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন হবে না।
কলেরার টিকার এখন সংকট রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় নাইজেরিয়ার বরাদ্দ থেকে টিকা নিয়ে আমাদের দেওয়া হয়েছে। এ কারণে একই সাথে সারা দেশে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হবে না।”
কলেরার মূল কারণ পানি দূষণ
এ বছর হঠাৎ করে কেন প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “কলেরার মূল কারণ হচ্ছে পানির দূষণ। দুষিত পানি পান করা থেকেই মূলত এই রোগের সূত্রপাত হয়।”
গরমের সময় পনির দূষণ বাড়ে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে ডায়রিয়া ও কলেরার রোগীও বাড়তে থাকে বলে জানান এই স্বাস্থ্য অধিকার কর্মী।
তিনি বলেন, “সরকারকে নিরাপদ পানি নিশ্চিতকরণ ও পর্যাপ্ত টিকাদানের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।”
গরম বাড়ার কারণে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে ডা. রশিদের এই মতামতের সাথে একমত পোষণ করে আইসিডিডিআর,বি এর হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম বলেন, ডায়রিয়া মোকাবেলা তুলনামূলক সহজ হলেও কলেরা নিয়ে উদ্বেগের মূল কারণ হলো এটি রোগীকে দ্রুত পানিশূন্য করে ফেলে।
কলেরা আক্রান্ত হলে ড্রিহাইড্রেশনের কারণে দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক রোগী মারা যেতে পারে, জানিয়ে তিনি বলেন, আক্রান্ত হলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
কলেরার লক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বেনারকে জানান, পাতলা পায়খানা, খিঁচুনি, গলা শুকিয়ে যাওয়া এবং বমি বমি ভাব হলো কলেরার লক্ষণ।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে পর্যাপ্ত স্যালাইন খাওয়ার পাশাপাশি দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ এই চিকিৎসকের।
এদিকে জনসাধারণকে বিশুদ্ধ পানি পান করা এবং ডায়রিয়া হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল।
ঢাকার বাইরে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন হাসপাতাল ডায়রিয়ার রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
ফরিদপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, রোগী সামাল দিতে গিয়ে নার্স ও চিকিৎসকদের বেগ পোহাতে হচ্ছে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে। এই হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১০টি শয্যার বিপরীতে ১৩ গুণ রোগী ভর্তি রয়েছে।
পাবনা সদর হাসপাতালে ১৫ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বর্তমানে ১১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শয্যা না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দা ও করিডোরে অবস্থান করতে হচ্ছে রোগীদের।
একই পরিস্থিতি নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
যোগাযোগ করা হলে হেলথ কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ আব্দুর রহিম বেনারকে জানান, শুক্রবার সকাল আটটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র ঢাকায় আইসিডিডিআরবিতে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে ৯১৬জন। চলতি মাসের প্রথম ২২দিনে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটিতে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৩৭৩।
তিনি জানান, দেশে মার্চ মাসে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৭০ হাজার ২৩৭, ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৫৯ এবং জানুয়ারিতে ছিল এক লাখ ৫২ হাজার ৫১৫।
শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাই এই পরিসংখ্যানে যুক্ত হন জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, এর কয়েকগুণ রোগী বাসা বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন।