বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচক: টানা চার বছর একই জায়গায় আছে বাংলাদেশের দুর্নীতি পরিস্থিতি
2022.01.25
ঢাকা

বাংলাদেশে দুর্নীতি কমানোর দায়িত্ব যাদের, তাঁদের একাংশই দুর্নীতির সাথে জড়িত হবার কারণে দেশের দুর্নীতি পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১ (সিপিআই) প্রকাশকালে এমন মন্তব্য করে দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশের অবস্থানকে “হতাশাব্যাঞ্জক” বলে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টানা চতুর্থবারের মতো এবারেও দুর্নীতি সূচকে ১০০’র মধ্যে বাংলাদেশ স্কোর করেছে ২৬। বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা গত বছর ছিল ১২তম।
“এই এক ধাপ উন্নতির মধ্যে দিয়ে এটা প্রমাণ করে না যে বাংলাদেশ দুর্নীতি কমাতে সক্ষম হয়েছে,” জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তনের কারণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ‘পারফরমেন্স’।
তিনি বলেন, “অপরিবর্তিত স্কোরই মূল বিষয়,” যা দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার ক্ষেত্রে “আশঙ্কাজনক।”
“সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলেও সেটি ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। কারণ, যাদের হাতে এই দায়িত্ব, তাঁদের একাংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
অবস্থানের পরিবর্তন না হওয়া ‘হতাশাব্যাঞ্জক’
টিআইর দুর্নীতি সূচকে টানা চার বছর ধরেই বাংলাদেশের স্কোর ২৬। গত দশ বছরে মধ্যে ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ২৮ ও ২০১৪-১৫ সালে সর্বনিম্ন ২৫ স্কোর করেছিল বাংলাদেশ।
সিপিআই সূচকে ১০০’র মধ্যে যে দেশের স্কোর যত কম, সেই দেশ তত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে গণ্য। এর আগে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ২ এর নিচে স্কোর করে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পাঁচবার টিআই প্রতিবেদনে জায়গা করে নিয়েছিল।
“গত এক দশকের স্কোরের বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ২৬-এ স্থবিরতা এবং সার্বিকভাবে অবস্থানের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না হওয়া হতাশাব্যাঞ্জক,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
চলতি বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মতো একই অবস্থানে রয়েছে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নিচে শুধু আফগানিস্তানের অবস্থান। তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ দক্ষিণ সুদান। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড।
“২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে অষ্টমবারের মতো এবারও বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন, যা বিব্রতকর, উদ্বেগজনক ও হতাশার,” জানায় টিআইবি।
“যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘শূন্য সহনশীলতার’ অঙ্গীকার বাস্তবে প্রয়োগ করা যেত, দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকরতা ও বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত করা যেত এবং সরকারি ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্তিগত উন্নয়নের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা যেত,” তাহলে সূচকে বাংলাদেশের আরো ভালো করার সুযোগ ছিল বলে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ অতিমারির সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রকট দুর্নীতি- বিশেষ করে, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচার না হওয়া, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার ঘাটতিও আমাদের অবস্থানের উন্নতিতে অন্তরায় হয়েছে।”
দুর্নীতি ও অপরাধের সাথে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা এবং ‘রাঘবোয়ালদের’ জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বাংলাদেশের আরো অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ নষ্ট করেছে, বলেও মত দেন তিনি।
“দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের দুই-তিন শতাংশ ক্ষতি হয়,” জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে যারা ঘুষ প্রদানে বাধ্য হন, তাঁদের ৮৯ শতাংশের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঘুষ ছাড়া সরকারি সেবায় অভিগম্যতা অসম্ভব।”
তিনি বলেন, “যেসব ব্যক্তি দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।”
এবারের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে, সূচকে ৬৮ স্কোর পেয়ে উপর থেকে অবস্থান ২৫তম। এ অঞ্চলের আটটি দেশই এবার ২০২০ এর তুলনায় অধিক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ভুটান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানের স্কোর হ্রাস পেয়েছে।
মাঠের চিত্র ভিন্ন
টিআই প্রতিবেদন সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা দুর্নীতি বন্ধের বিষয়ে খুবই আন্তরিক, কিন্তু মাঠপর্যায়ে এই চিত্রটা ভিন্ন।”
“তবে শুধুমাত্র একা দুদকের পক্ষে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে,” বলেন তিনি।
টিআইবিসহ অন্যান্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর প্রতি আহবান জানিয়ে গোলাম রহমান বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার এবং সচেতন করতে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
সরকার ও দুদক চুপ
মঙ্গলবার সিপিআই ২০২১ প্রকাশ পেলেও এটি নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কেউ মন্তব্য করেননি।
বেনারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি এই প্রতিবেদন দেখিনি এবং এ নিয়ে মন্তব্য করতে আগ্রহী নই।”
দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এই প্রতিবেদন সম্পর্কে মতামত দেয়নি মঙ্গলবার।
যোগাযোগ করা হলে, দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ আরিফ সাদিক বেনারকে বলেন, “ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন সম্পর্কে আগামীকাল প্রতিক্রিয়া জানাবে দুদক।”