সংবাদ প্রকাশে সীমাবদ্ধতায় বাংলাদেশি সম্পাদকদের হতাশা

জন ব্যাকটেল
2021.02.03
ওয়াশিংটন ডিসি
সংবাদ প্রকাশে সীমাবদ্ধতায় বাংলাদেশি সম্পাদকদের হতাশা জাপানের রাজধানী টোকিওতে ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার পর মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩০ মে ২০১৯।
[এপি]

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে অভিযুক্ত করে আল জাজিরার তথ্যচিত্রমূলক প্রতিবেদন নিয়ে ‘অদ্ভুত এক পরিস্থিতির’ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে।

দেশের গণমাধ্যমগুলো ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেও, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘ভয়ে’ মূল প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু, কিংবা সেখানে কাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, এমন কি সরকার কোন প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সেসব বিষয়ে কিছু বলা হচ্ছে না কোথাও। 

“কোন বিষয়ে সরকার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তা প্রকাশ না করে কেবলমাত্র সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি,” বুধবারের সম্পাদকীয়তে জানায় দৈনিক ডেইলি স্টার।

“এখন পর্যন্ত আমরা আল জাজিরার প্রতিবেদন বা এর কোনো অংশই প্রকাশ করিনি,” বলা হয় এতে।

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার তথ্যচিত্র ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ বা ‘তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর লোক’ প্রকাশিত হয় সোমবার।

তথ্যচিত্রে কী বলা হয়েছে সে সম্পর্কে লিখতে না পারার হতাশা প্রকাশ করে ইংরেজিতে লেখা ‘কেন এই নীরবতা?’ শিরোনামে বুধবারের সম্পাদকীয়তে ঢাকা ট্রিবিউন জানায়, দেশের গণমাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের “একটি ভীতিকর প্রভাব” রয়েছে।

“এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের নীরবতা একই সূত্রে গাঁথা,” বলে ঢাকা ট্রিবিউন।

“আমাদের নীরবতার কারণ খুব সাদামাটা,” জানিয়ে এতে বলা হয়, বাংলাদেশের অবমাননা বিষয়ক আইন, বিচার ব্যবস্থায় আইনটির ব্যাখ্যা, এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশের যে কোনো গণমাধ্যমের পক্ষে বিতর্কিত কোনো বিষয়ে পা বাড়ানো “বোকামি।”

ঢাকা ট্রিবিউন জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রতিবেদনের সুযোগ বাধাগ্রস্ত করে এবং ঘটনার পরবর্তীতে এমন দানবীয় হুমকির মুখে ফেলে যে, কোনো দায়িত্বশীল সম্পাদকই এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে চান না, যেটি কোনো না কোনোভাবে এই আইনের আওতায় পড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী সমন ছাড়াই পুলিশ যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। আইনটি একই সাথে জামিন অযোগ্য, ফলে এই আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মানেই অবধারিতভাবে কারাবাস।

করোনাভাইরাস মহামারিকালে অন্তত ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল বলে ২০২০ সালের জুনে জানিয়েছিল বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ। 

বুধবার বেনারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও শীর্ষ স্থানীয় দশটির বেশি বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ঘেঁটে দেখা যায়, সব পত্রিকা গত দুই দিন ধরে আল জাজিরার প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। তবে কেউই প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, আইজিপিসহ শীর্ষস্থানীয়দের বিরুদ্ধে মূল প্রতিবেদনে কী অভিযোগ করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি বাক্যও প্রকাশ করেনি। 

আল জাজিরার অভিযোগ

আল জাজিরার তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের এক ভাই হারিস আহমেদ পরিচয় বদলে হাঙ্গেরিতে ‘মোহাম্মদ হাসান’ নামে বসবাস করছেন।

অন্য ভাই আনিস আহমেদ রয়েছেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। তাঁরা দুজনই ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরে আলোচিত মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের দায়ে দণ্ডিত এবং পলাতক। তাঁদের একজন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ।

গোপনে সংগ্রহ করা বিভিন্ন নথিপত্র দেখিয়ে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, সেনাপ্রধান তাঁর ভাই হারিস আহমেদের জন্য ভুয়া পাসপোর্ট ও অন্যান্য ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করতে সেনা কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন।

আল জাজিরা জানায়, হারিস আহমেদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণদের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে অবৈধভাবে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।

“এমনকি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হারিস যদি কিছু করতে চায় তবে তাকে তা করতে দাও। আমরা সাহায্য করব,” তথ্যচিত্রের একটি ভিডিও ক্লিপে বলেন হারিস।

এছাড়া ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য নিষিদ্ধ হলেও সামরিক বাহিনীর জন্য ইসরাইলে নির্মিত সেলফোন নজরদারির প্রযুক্তি কিনতে সেনাপ্রধান তাঁর ভাই হারিসকে গোপনে সাহায্য করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয় ওই তথ্যচিত্রে। 

সরকারের মতে ‘অপপ্রচার’

আল জাজিরার প্রতিবেদনটিকে ‘মিথ্যা’ ‘অবমাননাকর’ এবং বাংলাদেশ বিরোধী “অপপ্রচার’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করলেও প্রতিবেদনের অভিযোগগুলো সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানায়নি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।

এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্লক না করা “সরকারের একটি সুচিন্তিত ও ভালো সিদ্ধান্ত” বলে মন্তব্য করে ডেইলি স্টার।

তবে কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কোনো আলোচনা না হওয়ার জন্য হতাশাও প্রকাশ করে পত্রিকাটি।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, সেনাপ্রধানের ভাই হাসান এক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী ছিলেন। সেই সুবাদে দাপট খাটিয়ে তিনি বর্তমানে অবৈধভাবে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলছেন।

“এমন অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন, বিশেষ করে তাঁর সংগ্রামের সময়গুলোতে। তাঁরা এখন প্রধানমন্ত্রীর কৃতজ্ঞতাবোধের পুরোপুরি সুযোগ নিচ্ছেন এবং আমাদের কিছু অতি সংবেদনশীল জায়গায় প্রভাব বিস্তার করছেন,” বলে ডেইলি স্টার। 

এতে বলা হয়, “প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। অথচ, দেশটিকে আমরা স্বীকৃতি দিইনি। এ ছাড়া, ভুয়া পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক নথিগুলোর বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এগুলোর পেছনে এমন সংস্থার নাম জড়িত, যাদের সততা ও নিরপেক্ষতার ওপর আমাদের নিরাপত্তা নির্ভর করে।”

“সরকার এগুলো উপেক্ষা করলে বিপদ বাড়তে পারে,” বলে ডেইলি স্টার।

তবে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায় “প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।”

“ক্রয়কৃত সরঞ্জাম কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্রেই এগুলো ইসরায়েলের তৈরি বলে উল্লেখ নেই,” জানানো হয় এতে। 

বেনারের পক্ষ থেকে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে জানান, সাধারণত তাঁর যা বক্তব্য তিনি তা লিখেই প্রকাশ করেন। 

প্রসঙ্গত, মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ২০১৬ সাল থেকে দেশের ১৬টি জেলায় দায়ের করা ৮১টি মামলা রয়েছে বলে বেনারকে জানান তাঁর আইনজীবী চৈতন্য চন্দ্র হালদার। তবে সবগুলো মামলাতেই বর্তমানে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে বলে জানান তিনি। 

গণমাধ্যমের ‘স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণ’

বাংলাদেশে সরকার গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।

“এটা নিশ্চিত যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন সরকার, সেনাবাহিনী, সরকারি কেনাকাটা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন তুলেছে, কিন্তু তার পরেও এ সম্পর্কে বাংলা গণমাধ্যমে প্রতিবেদনের সংখ্যা খুবই অল্প। এ থেকে মোটা দাগে আমরা বুঝতে পারি বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব কতটুকু,” বেনারকে বলেন সিপিজে’র এশিয়া বিষয়ক গবেষক আলিয়া ইফতিখার। 

“বিগত বছরগুলোতে আমরা অনেক গণমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে দেখেছি, যাদের অনেকে শুধু সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের অপরাধে মাসের পর মাস এই দানবীয় আইনে জেল খেটেছেন,” মন্তব্য করে আলিয়া বলেন, “সুতরাং এটা বিস্ময়কর না যে, জেল খাটার ভয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের’ পথ বেছে নিচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।