জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশি সদস্য বাড়ানোর আলোচনা স্থগিতের দাবি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর
2021.02.08
ওয়াশিংটন ডিসি

বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সাথে জাতিসংঘের সম্পর্ক নতুন করে যাচাইর দাবি জানিয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
পাশাপাশি, সাম্প্রতিক একটি তথ্যচিত্রে সামরিক বাহিনীর জন্য মোবাইল ফোন নজরদারি সরঞ্জাম কেনাকাটা সংক্রান্ত দুর্নীতির সাথে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বর্তমানে সরকারি সফরে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন। সফরকালে গত সপ্তায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধানসহ বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করেছেন।
চলতি সপ্তায় তাঁর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের শান্তিরক্ষা মিশনের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক ও আলোচনা করার কথা রয়েছে।
এসব বৈঠকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আলোচনা করবেন বলে তাঁর সফর শুরুর আগে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ সাতটি মানবাধিকার সংস্থা সম্প্রতি এক যৌথ বিবৃতিতে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশি সদস্যদের কারো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অতীত রেকর্ড আছে কি না তা যাচাই না করা পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস সোমবার বেনারকে বলেন, “আল জাজিরার অভিযোগগুলো বাংলাদেশের তদন্ত করা উচিত বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু আমরা বলেছি, ‘না, জাতিসংঘেরই উচিত ওই অভিযোগগুলো তদন্ত করা।’ শান্তিরক্ষা বাহিনীর কোনো সদস্য কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটাননি, এটা নিশ্চিত করা জাতিসংঘের দায়িত্ব।”
এদিকে বাংলাদেশি সেনাপ্রধান মঙ্গলবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সদরদপ্তরে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফর পিস অপারেশনস এর সাথে বৈঠক করবেন বলে সোমবার বেনারকে জানান জাতিসংঘ সদরদপ্তরের এক মুখপাত্র।
গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ওই প্রতিবেদনে গোপনে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখানো হয়, সেনাপ্রধানের এক ভাই বলছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অভিজাত বাহিনী র্যাবের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই বিচারবহির্ভূত হত্যা, নাগরিকদের গুম করা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। র্যাবের অনেক সদস্যই সেনাবাহিনী থেকে আসেন।
গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সিনেটর র্যাবের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিও জানিয়েছিলেন নিজেদের সরকারের কাছে।
“দেশটির সেনাবাহিনী সম্পর্কে জাতিসংঘের সার্বিক পর্যালোচনার ফলাফল, ও তাদের সাথে জাতিসংঘের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশি সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত করা উচিত,” বিবৃতিতে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
“জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সদস্য সংকটে পড়ুক তা আমরা চাই না, এর সমাধান হলো যথাযথ যাচাই। বাংলাদেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত না হলেও র্যাব এবং সেই বাহিনী থেকে আসা যে কোনো সদস্যই সন্দেহভাজন। জাতিসংঘের উচিত এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা, যাতে তারা বলতে পারে যে, র্যাব থেকে যেসকল সদস্য আসছেন তাঁরা কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত নন,” বলেন ব্র্যাড অ্যাডামস।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশি বাহিনীগুলোকে নিষিদ্ধ করার কথাও ভাবতে পারে জাতিসংঘ।
“বর্তমানে কর্মরত বাংলাদেশি কোনো শান্তিরক্ষা বাহিনীর যদি অপরাধের সাথে যুক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে,” বেনারকে বলেন কুগেলম্যান।
আল জাজিরার অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রের অভিযোগ করা হয়, ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য নিষিদ্ধ হলেও সামরিক বাহিনীর জন্য ইসরাইলে নির্মিত সেলফোন নজরদারির প্রযুক্তি কেনা হয়েছে।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এক বিবৃতিতে আইএসপিআর জানায় ওই সরঞ্জামগুলো মূলত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছিল। এবং ওই সরঞ্জামগুলোর কোনো নথিপত্রেই সেগুলো ইসরায়েলের তৈরি বলে উল্লেখ নেই।
তবে বাংলাদেশের এই বিবৃতির পর এক নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানান, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশি সদস্যদের ওরকম কোনো সরঞ্জাম ব্যবহারের কথা নয় এবং তাঁদেরকে ওরকম কোনো সরঞ্জাম সরবরাহও করা হয়নি।
বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আল জাজিরার করা “দুর্নীতির অভিযোগগুলো গুরুতর, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এগুলো তদন্ত করা,” মন্তব্য করেন ডুজারিক।
যুক্তরাষ্ট্র সফর
এদিকে গত সপ্তায় বাংলাদেশে সেনাপ্রধানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকর্মকর্তাদের বৈঠক না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ব্র্যাড অ্যাডামস ও কুগেলমেন।
“যেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেবার পাশাপাশি, অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ক্ষেত্রে সেগুলো দূর করার আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন, সেখানে এই বৈঠকটি মানানসই নয়। প্রশাসনের উচিত অভিযোগের বিষয়গুলো বৈঠকে উত্থাপন করা।"
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে এমন বিদেশি কর্মকর্তাদের সাথে প্রকাশ্য বৈঠক না করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দীর্ঘদিন থেকে এইচআরডব্লিউ আহ্বান জানিয়ে আসছে বলে জানান অ্যাডামস।
“আমরা জেনারেল আজিজের সাথে বৈঠক বাতিল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, কিন্তু তারা তা করেনি, তারা জানিয়েছে এই বৈঠকগুলো নিয়মিত রুটিন এবং নির্ধারিত বৈঠক। তাদেরও ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন যে তারা কেন তা (বৈঠকগুলো) অব্যাহত রাখল,” বলেন অ্যাডামস।
এর আগে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সম্পর্কে ‘আমরা অবগত’ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে জেনারেল আজিজের বৈঠকের বিষয় বেনারকে নিশ্চিত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লে. কর্নেল কার্টিস কেলগ।
তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে বৈঠকের তারিখ ও স্থান বিষয়ক তথ্য দিতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
বেনারের পক্ষ থেকে থেকে সোমবার তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে, এ বিষয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই বলে জানান কেলগ।
“তারা কার লোক?”
প্রথম দিকে আল জাজিরার অভিযোগগুলোর সম্পর্কে প্রায় নীরব থাকলেও ধীরে ধীরে বাংলাদেশি গণমাধ্যমেও এ বিষয়ক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে শুরু করেছে।
বিশেষত, দাবি উঠেছে যারা নিজেদের সরকারি পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তাঁদের পরিচয় উন্মোচন করা জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন।
আল জাজিরার ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ প্রতিবেদনের সূত্র টেনে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক মতামত প্রশ্ন তোলা হয়েছে “তারা কার লোক?”
প্রসঙ্গ, আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সেনাপ্রধানের ভাইদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের জেরেই প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা নিজেদের দুর্নীতি অব্যাহত রেখেছেন।
কে কার লোক হবে তা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয় মন্তব্য করে ওই মতামতে বলা হয়, “কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু মানুষের নাম উঠে আসছে জাতীয় স্বার্থে যাদের পরিচয় উন্মুক্ত করা প্রয়োজন।”
আল জাজিরার এক ঘণ্টার তথ্যচিত্রমূলক প্রতিবেদন ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’কে ‘মিথ্যা’ ‘অবমাননাকর’ এবং বাংলাদেশ বিরোধী ‘অপপ্রচার’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।
একই সাথে জানানো হয়েছে, এই প্রতিবেদনের জন্য আল জাজিরার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবার কথাও ভাবা হচ্ছে।
তবে এই ‘মিথ্যা’ প্রতিবেদনের বিপরীতে সরকারের এখন “বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি, যদি থেকে থাকে” তা প্রকাশ করা উচিত বলে সম্পাদকীয়তে দাবি জানায় নিউ এজ।
সরকারের কাছে জাতির এখন “কিছু ব্যাখ্যা পাওনা” হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করা হয় এতে।