আল জাজিরার ‘অপপ্রচারের’ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান
2021.02.16
ঢাকা

কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল–জাজিরায় বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের পরিবার ও সরকারকে যুক্ত করে প্রচারিত তথ্যচিত্র প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন জেনারেল আজিজ আহমেদ।
মঙ্গলবার সেনা এভিয়েশন গ্রুপের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার পর সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর কোনো ভাই পলাতক অথবা অপরাধী নন। কারণ তাঁদের সাজা মওকুফ করে দিয়েছে সরকার।
গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে বলা হয়, সেনাপ্রধানের দুই ভাই আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদ একটি খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং তাঁরা পলাতক। মালয়েশিয়া সফরের সময় সেনাপ্রধান তাঁর ‘পলাতক’ ভাইদের সাথে সাক্ষাত করেন।
আল জাজিরার এই তথ্যচিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মঙ্গলবার সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আপনার বিরুদ্ধে মামলা আছে, সাজা আছে। কিন্তু আপনি যদি গতকাল সাজা থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন, আপনার বিরুদ্ধে আর যদি কোনো মামলা রানিং না থাকে, আপনাকে কি ফিউজিটিভ (পলাতক) বলা যাবে আজকে?”
“আমার ভাইয়ের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় যখন দেখা করেছি, তখন তার নামে কোনো মামলা ছিল না। যে একটা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলা ছিল, সেটি থেকে অলরেডি অব্যাহতিপ্রাপ্ত ছিল। সে অব্যাহতি মার্চ মাসে হয়েছিল, আমি এপ্রিল মাসে গিয়েছিলাম,” বলেন সেনাপ্রধান।
আল জাজিরার প্রতিবেদনের তথ্যগুলো সম্পূর্ণ ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ দেয়া হয়েছে জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “যা কিছু আপনারা শুনছেন, এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই।”
তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে আল জাজিরার “অপপ্রচারগুলো” সম্পর্কে শিগগির তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করে “সব কিছু জানানো হবে” বলেও জানান সেনাপ্রধান।
আল জাজিরার তথ্যচিত্রে বলা হয়, সেনাপ্রধানের তিন ভাই—আনিস আহমেদ, হারিস আহমেদ এবং তোফায়েল আহমেদ জোসেফ বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত। এবং তাঁরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ।
ঢাকায় একটি হত্যাকাণ্ডের দায়ে ২০০৪ সালে জোসেফের মৃত্যুদণ্ড এবং হারিস ও আনিসের যাবজ্জীবন হয়। জোসেফ কারাগারে থাকলেও আনিস ও হারিস পলাতক ছিলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জোসেফের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করে দেয় সরকার, পরে তিনি সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে ছাড়া পান।
এদিকে সোমবার এক প্রতিবেদনে দৈনিক প্রথম আলো জানায়, ২০১৮ সালের ২৫ জুন জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হবার এক মাস আগে, ২৭ মে সাজা মওকুফের পর ছাড়া পান জোসেফ।
এতে বলা হয়, সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার প্রায় নয় মাস পর ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ হারিস আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের সাজা মওকুফের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
উল্লেখ্য, এই সাজা মওকুফের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো খবর তখন প্রকাশিত হয়নি। বিষয়টি জনসমক্ষেও আসেনি।
আল জাজিরার অভিযোগ সেনাবাহিনীর প্রত্যাখ্যান
আল জাজিরার প্রতিবেদন সম্পর্কে সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, ওই তথ্যচিত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসরাইল হতে স্পাইওয়্যার ক্রয় করা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী প্রধানের ভাইকে সম্পৃক্ত করে কিছু মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে সামি নামের যে ব্যক্তির বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তাঁর প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান বলে জানায় আইএপিআর।
চুরি, সেনাবাহিনীর পোশাক এবং ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে প্রতারণার অপরাধে সামি বিভিন্ন সময়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাতে গ্রেপ্তার হন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সামি বর্তমানে ভুয়া পরিচয়ে পলাতক অবস্থায় হাঙ্গেরিতে বসবাস করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে ঢাকায় ২০২০ সালের মে মাসে দায়ের করা একটি মামলা তদন্তাধীন।
আইএসপিআর জানায়, সামির মতো একজন “প্রতারক ও পলাতক ব্যক্তির” কাছ থেকে একতরফাভাবে পাওয়া “অনির্ভরযোগ্য ও বিভ্রান্তিকর” তথ্য দিয়ে “ভিত্তিহীন তথ্যচিত্র” তৈরি করার কারণে আল জাজিরার প্রতিবেদন “গ্রহণযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।”
কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া আল জাজিরার “অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” প্রতিবেদনে সেনাপ্রধানকে “ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিকভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত করার অপপ্রয়াস”কে সেনাবাহিনী “ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে,” বলা হয় আইএসপিআরের বিবৃতিতে।
এদিকে মঙ্গলবার সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিধায় বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করেনি সরকার।
তবে তাঁর মতে, “প্রতিবেদনটা দেখেশুনে মনে হয়েছে এটি ব্যক্তিগত আক্রোশবশত।”
তিনি বলেন, “সমস্ত গণমাধ্যমেরও নিজস্ব দায়িত্ব থাকে। আল জাজিরা এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বশীলতা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।”
সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আল জাজিরার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আদালতে যায় সেক্ষেত্রে আদালত থেকে যদি কোনো নির্দেশনা পাই তাহলে আদালতের নির্দেশনা অবশ্যই পালন করব।”
প্রসঙ্গত, শুরু থেকেই “মিথ্যা ও অবমাননাকর” আখ্যা দিয়ে আল জাজিরার এই প্রতিবেদনটিকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে বাংলাদেশ সরকার।