ফেসবুক, ইউটিউব থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদন সরাতে বলল আদালত

বেনার স্টাফ
2021.02.17
ঢাকা
ফেসবুক, ইউটিউব থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদন সরাতে বলল আদালত দোহায় আল জাজিরার সদরদপ্তরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মোস্তেফা সুয়াগ। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[এএফপি]

সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাইদের বিপক্ষে অভিযোগ ওঠানো আল জাজিরার “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারস মেন” সরিয়ে ফেলতে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে বুধবার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। 

‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ তৈরি ও অভিযোগগুলোর কোনো প্রমাণ নেই বলে সেনাপ্রধান ওই প্রতিবেদনটিকে প্রত্যাখ্যান করার একদিন পর আদালতের নির্দেশে এমন উদ্যোগ নিলো বিটিআরসি। 

বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তথ্যচিত্রটি সরিয়ে নেয়ার আদেশ চেয়ে আইনজীবী এনামুল কবির ইমনের দায়ের করা রিটের ওপর বুধবার বিকেলে আদেশ দেয় বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। 

আদেশে বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধের বিষয়টি খারিজ করে দিয়ে আদালত বলেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থেকে ডকুমেন্টারিটি যেন সরিয়ে নেয়া হয়।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আল জাজিরার ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে ফেলার জন্য হাইকোর্টেরে আদেশের কপি আমরা হাতে পাইনি,” জানিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বুধবার বেনারকে বলেন, “কিন্তু আমরা আদেশ হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করিনি।” 

তিনি বলেন, “আদালতে আমাদের আইনজীবী মারফত জানার পর আমরা ওই ডকুমেন্টারি সরিয়ে নিতে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছি।

“আমার মনে হয়, তারা আদালতের আদেশকে সম্মান করবে,” বলেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান। 

বাংলাদেশের অনুরোধে ফেসবুক ও ইউটিউব যদি ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে না নেয় তবে “এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় ভেবে দেখব,” জানিয়ে শ্যাম সুন্দর বলেন, “আমাদের এখান থেকে ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে নেয়া একটি জটিল ব্যাপার।” 

কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ফেসবুক ও ইউটিউব এর কোনো কার্যালয় নেই। তাছাড়া, ফেসবুক ও ইউটিউব মার্কিন আইনে পরিচালিত হয়।” 

বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালত আদেশ দিলেও ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে এই ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে নেবার সক্ষমতা সরকারি এজেন্সিগুলোর নেই। 

“আল জাজিরা ওই ডকুমেন্টারি তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে আপলোড করেছে। কাজেই, এটি সরিয়ে নিতে হলে আল জাজিরাকেই ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে,” বুধবার বেনারকে বলেন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা। 

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশি আদালতের আদেশ শুনবে বলে মনে হয় না। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন আইনে চলে,” বলেন তিনি। 

তাঁর মতে, “সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যা করতে পারে তা হলো, আল জাজিরার ডকুমেন্টারিটি ইউটিউবে শেয়ার করা অ্যাকাউন্টগুলোর ইউআরএল বন্ধ করতে পারে।” 

“তবে এক্ষেত্রে তথ্যচিত্রটি শুধু, ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ থেকে দেখা বন্ধ করা যাবে, মোবাইল ফোন ও ট্যাব থেকে দেখা বন্ধ করা যাবে না,” জানান জোহা। 

তিনি বলেন, “এই ডকুমেন্টারিটি ভাইরাল হয়েছে। এটি এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, তা বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থেকে সরিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব।” 

বুধবার এক বিবৃতিতে আল জাজিরা জানায়, ১ ফেব্রুয়ারি প্রচারের পর থেকে ডকুমেন্টারিটি ইউটিউবে ৬৫ লাখ বার দেখা হয়েছে। 

প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এই প্রতিবেদন তৈরির সময় সাংবাদিকতার নীতিমালা শতভাগ রক্ষা করা হয়েছে। এবং এই প্রতিবেদনটি তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট সাহসী মানুষেরা যারা তাঁদের নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে কাজ করেছেন আল জাজিরা তাঁদের সাথে রয়েছে। 

‘সম্প্রচার বন্ধের বিপক্ষে আইনজীবীরা’

ডকুমেন্টারিটি প্রচার হওয়ার পর বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে ফেলতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এনামুল কবির ইমন। 

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ছয় সিনিয়র আইনজীবীর মতামত চায় হাইকোর্ট। 

“ছয় আইনজীবীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনজীবীরা বাংলাদেশে আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করার বিরুদ্ধে মতামত দেন। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত,” বুধবার বেনারকে বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। 

তিনি বলেন, “তাঁদের অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ডকুমেন্টারিটি সরিয়ে নেয়ার বিপক্ষে মতামত দেন। তাঁদের মতে, রিটকারী এই তথ্যচিত্রটি প্রচারের কারণে সংক্ষুব্ধ নয়।” 

“কিন্তু আমি আদালতে বলেছি, আল জাজিরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে মাফিয়া রাষ্ট্র বলা হয়েছে। এই শব্দের কারণে দেশের প্রতিটি নাগরিক সংক্ষুব্ধ,” জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। 

এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার আদালত “ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে তথ্যচিত্রটি সরিয়ে নিতে বিটিআরসি’কে নির্দেশ” দিয়েছে বলে জানান তিনি। 

এদিকে বুধবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আল জাজিরার ওই প্রতিবেদন তৈরিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক ডেভিড বার্গম্যান, তথ্য সহায়তাকারী সামি, সাংবাদিক তাসনীম খলিল ও আল জাজিরার মহাপরিচালক মোস্তেফা সুয়াগকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী মশিউর মালেক। 

তবে আদালত এ ব্যাপারে কোনো আদেশ দেয়নি। মামলায় অভিযুক্ত ওই চারজনই বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন। 

এই মামলার বিবাদীরা দেশের বাইরে অবস্থান করলেও মামলার অর্থ আছে বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরু।

“যখনই তাঁরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করবেন তখন তাঁদের এই মামলা মোকাবিলা করতে হবে,” বলেন তিনি। 

সেনাপ্রধান যা বললেন

গত ১ ফেব্রুয়ারি প্রচারিত কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার’স মেন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে বলা হয়, সেনাপ্রধানের দুই ভাই আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদ একটি খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং তাঁরা পলাতক। মালয়েশিয়া সফরের সময় সেনাপ্রধান তাঁর ‘পলাতক’ ভাইদের সাথে সাক্ষাত করেন। 

তবে মঙ্গলবার সেনা এভিয়েশন গ্রুপের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার পর সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর কোনো ভাই পলাতক অথবা অপরাধী নন। কারণ তাঁদের সাজা মওকুফ করে দিয়েছে সরকার।

“আমার ভাইয়ের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় যখন দেখা করেছি, তখন তার নামে কোনো মামলা ছিল না। যে একটা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মামলা ছিল, সেটি থেকে অলরেডি অব্যাহতিপ্রাপ্ত ছিল। সে অব্যাহতি মার্চ মাসে হয়েছিল, আমি এপ্রিল মাসে গিয়েছিলাম,” বলেন সেনাপ্রধান।

আল জাজিরার প্রতিবেদনের তথ্যগুলো সম্পূর্ণ ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ দেয়া হয়েছে জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, “যা কিছু আপনারা শুনছেন, এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই।” 

তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে আল জাজিরার “অপপ্রচারগুলো” সম্পর্কে শিগগির তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করে “সব কিছু জানানো হবে” বলেও জানান সেনাপ্রধান। 

আল জাজিরার তথ্যচিত্রে বলা হয়, ঢাকায় একটি হত্যাকাণ্ডের দায়ে ২০০৪ সালে জোসেফের মৃত্যুদণ্ড এবং হারিস ও আনিসের যাবজ্জীবন হয়। জোসেফ কারাগারে থাকলেও আনিস ও হারিস পলাতক ছিলেন। আনিস বসবাস করছেন মালয়েশিয়াতে ও হারিস হাঙ্গেরিতে। পরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ছাড়া পান জোসেফ।

তবে সোমবার এক প্রতিবেদনে বাংলা দৈনিক প্রথম আলো জানায়, ২০১৮ সালের ২৫ জুন জেনারেল আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান নিযুক্ত হবার এক মাস আগে, ২৭ মে সাজা মওকুফের পর ছাড়া পান জোসেফ। 

এতে বলা হয়, সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার প্রায় নয় মাস পর ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ হারিস আহমেদ ও আনিস আহমেদের সাজা মওকুফের প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের সাজা মওকুফের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

এই সাজা মওকুফের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো খবর তখন প্রকাশিত হয়নি। বিষয়টি জনসমক্ষেও আসেনি।

এদিকে শুরু থেকেই “মিথ্যা ও অবমাননাকর” আখ্যা দিয়ে আল জাজিরার এই প্রতিবেদনটিকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।