ভেঙে পড়ল নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, অভিযুক্ত চীনা প্রতিষ্ঠান

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.15
ঢাকা
ভেঙে পড়ল নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, অভিযুক্ত চীনা প্রতিষ্ঠান ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ভেঙে পড়া অংশ সরানোর কাজ করছেন শ্রমিকরা। ১৪ মার্চ ২০২১।
Photo: Benar

ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার থেকে শতটনের একটি গার্ডার বা স্টিলের সংযোগ কাঠামো ভেঙে পড়ে চার শ্রমিক আহত হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে চীনা কোম্পানি যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও কর্মরত শ্রমিকেরা জানান, শনিবার দিবাগত দুইটার দিকে গার্ডারটি ধ্বসে পড়ে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ বের করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়। 

গত কয়েক বছর ধরে গাজীপুর থেকে ঢাকা মহানগরীতে ট্রান্সপোর্ট করিডোর নির্মাণের জন্য ঢাকা-গাজীপুর সড়কের ওপর পিলার বসিয়ে পিলারগুলো সংযোগের জন্য গার্ডার বসানোর কাজ চলছে। গার্ডারের নিচ দিয়ে যানবাহন চলাচল করে। এই গার্ডারের ওপরেই পরবর্তীতে সেতু নির্মাণ করা হয়ে থাকে। 

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চীনা জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টে এটি দ্বিতীয় গার্ডার ভেঙে পড়ার ঘটনা।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোথাও কোনো বক্তব্য–বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।

“প্রাথমিকভাবে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, চীনা এই কোম্পানি নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়নি,” সোমবার বেনারকে বলেন সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। 

তিনি বলেন, “তাদের উচিত ছিল, নির্মাণ এলাকাটি ঘিরে রাখা এবং গার্ডার যেন পড়ে না যায় সেব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সেটা করা হয়নি। সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না নেয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”

“এর আগেও একবার তাদের গার্ডার ভেঙে পড়ে,” জানিয়ে সেতু সচিব বলেন, ওই ঘটনার পর এই কোম্পানিকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও “তারা সেটি করেনি।”

“তবে, সুনির্দিষ্টভাবে কোন কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে” তা জানতে একজন উপসচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

“আমরা কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আমরা এই কোম্পানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব,” বলেন সচিব। 

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১০ লাখ মানুষকে ঢাকার সাথে উন্নত যাতায়াত সেবা দেয়ার জন্য এই প্রকল্প নেয় সরকার। 

বাংলাদেশ সরকার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ফরাসি উন্নয়ন ফান্ড ও গ্লোবাল ইনভায়রনমেন্ট ফান্ডের যৌথ অর্থায়নে ৯৩৫ কোটি টাকা (১১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয়ে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকার।

প্রকল্পটি ২০১৫ সাল শুরু হয়েছে বলে জানান সেতু সচিব। 

এই প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর থেকে টঙ্গি-আব্দুল্লাহপুর-এয়ারপোর্ট-বনানী হয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। ফলে গাজীপুর থেকে সহজেই ঢাকা শহরে পৌঁছানো যাবে। 

প্রকল্পের উত্তরা অংশে বোর্ডে দেয়া তথ্য অনুসারে এই প্রকল্পের ঠিকাদার চীনের জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। 

খরচ কমাতে সুরক্ষা ব্যবস্থায় অবহেলা 

রোববার প্রথম প্রহরে আব্দুল্লাহপুর মোড়ে ফোর্ড মটর শোরুমের উল্টোদিকেই গার্ডারটি ভেঙে পড়ে।

ফোর্ড মটর শোরুমের গার্ড ও প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল আজিজ বেনারকে বলেন, “এখানে দিনরাত কাজ চলে। গভীর রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে চারিদিক কেঁপে ওঠে। আমি সামনে গিয়ে দেখি গার্ডার ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে।”

তিনি বলেন, “আমরা যে, যেভাবে পেরেছি, আটকেপড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার চেষ্টা করি। বেশ কিছুক্ষণ পর ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।” 

আজিজ বলেন, “এখানে কাজের সময় চীনারা নির্দেশ দেন। আর বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজ করেন।”

এই প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিক মো. হাবিব সোমবার বেনারকে বলেন, “চীনা কোম্পানির লোকেরা প্রকল্পের কাজের জন্য স্থানীয় এক ঠিকাদারের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ করেছে। এই গার্ডার ভেঙে চার শ্রমিক আহত হয়েছেন। কোনো চীনা শ্রমিক আহত হয়নি বলে আমি জানি।” 

তিনি বলেন, “এই ব্যস্ত রাস্তার ওপরে পিলার (গার্ডার) বসানোর কাজ চলে। ভাগ্য ভালো গভীর রাতে এটি ভেঙেছে। পিলারের নিচ দিয়ে দিনরাত গাড়ি চলে। নিচে যদি কোনো গাড়ি থাকত তাহলে বড়ো দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।” 

দুর্ঘটনার পরদিন সোমবার বুলডোজার দিয়ে গার্ডার ভেঙে রড আলাদা করা হয়।

ঢাকা শহরের যেসব সড়কের ওপর দিয়ে গার্ডার বসানোর কাজ চলে সেখানে যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক।

নিচ দিয়ে যানবাহন চলাচল করার কারণে “পিলারের ওপর গার্ডার বসানোর কাজ খুব বিপজ্জনক,” জানিয়ে তিনি বলেন “ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান খরচ কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেন না।”

আবার এক্ষেত্রে “বাংলাদেশে যারা বাস্তবায়নকারী সংস্থা তারা ঠিকাদারদের কাজের তদারকি করেন না,” বলেও অভিযোগ করেন তিনি। 

“বাংলাদেশ আসলে বড়ো বড়ো প্রকল্পের দিকে নজর দিয়েছে। কিন্তু এর সাথে কাজের মান এবং তদারকির প্রয়োজন আছে সেব্যাপারে খুব একটা নজর নেই সরকারের,” বলেন অধ্যাপক শামসুল।

তাঁর মতে, “আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণ এবং কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় কোনো একদিন বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।