হল-মার্কের ঋণ কেলেঙ্কারি: এমডি ও চেয়ারম্যানসহ ৯ জনের যাবজ্জীবন
2024.03.19
ঢাকা

বাংলাদেশে বড়ো ব্যাংক কেলেঙ্কারিগুলোর অন্যতম সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ঋণের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে হল-মার্ক গ্রুপের নেওয়া প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনা, যা নিয়ে গত এক যুগ ধরে মোট ১১টি মামলা চলছে।
দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বেনারকে জানান, মঙ্গলবার একটি মামলায় মোট ১৭ জনকে সাজা দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। যার মধ্যে, হল-মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী; গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ নয়জনকে যাবজ্জীবন, সাতজনকে বিভিন্ন ধারায় মোট ১৭ বছর এবং একজনকে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান বেনারকে জানান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস নামে ভুয়া কোম্পানির হিসাবে ৫২৫ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের সুতা রপ্তানি করা হয়েছে বলে নথিপত্রে দেখানো হয়।
ওই হিসাবে পুরো অর্থ জমা করার পরে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা হল-মার্কের আরেকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ওই অর্থ তানভীর ও তাঁর স্ত্রী তুলে নেন।
মীর আহমেদ জানান, ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালতের বিচারক মো. আবুল কাশেম।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে হল-মার্ক গ্রুপের মালিক, কর্মকর্তা ও সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১টি মামলার মধ্যে এটি একটি।
তবে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, “আলোচিত এই ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যাঁদের সাজা হলো তাঁরাই সব নয়।”
“এই ঋণগুলো অনুমোদন দেওয়া থেকে শুরু করে নানা প্রক্রিয়ায় অনেক বড়ো বড়ো ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা অধরাই থেকে গেলেন,” বেনারকে বলেন তিনি।
একজন পালিয়ে গেছেন আদালত থেকে
তানভীর ও জেসমিন ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বাকি সাতজন হলেন; তানভীরের শ্যালক ও হল-মার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মালেক ও সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা শাখার কর্মকর্তা আব্দুল মতিন।
আদালত সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক সফিজউদ্দিন, সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামরুল হোসেন খান ও জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরীকে দুটি ধারায় ১০ বছর এবং আরও দুটি ধারায় সাত বছর করে মোট ১৭ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে।
এ ছাড়া, সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকারকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি জামিনে মুক্ত থাকলেও এদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং রায় ঘোষণার সময় পালিয়ে যান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী হারুন অর রশিদ আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, “জামাল উদ্দিন রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পরে পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি কোর্টে নেই। পরবর্তীতে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে হুমায়ুন, জামাল, সাইফুল ইসলাম, মতিন, ননী গোপাল, তসলিম, সাইফুল হাসান, মেরী ও জাকারিয়া পলাতক। তানভীর, জেসমিন ও তুষারসহ বাকি আসামিরা এখন কারাগারে।
ব্যাংকিং ইতিহাসে বিস্ময়কর ঘটনা: আদালত
হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি ব্যাংকিং ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে আদালত।
মীর আহমেদ জানিয়েছেন, ২৪৮ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করেন, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করে। তবে সংশ্লিষ্ট আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তাই নয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মীর আহমেদ আরও বলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় শুনে আদালত কক্ষে পাশাপাশি বসে থাকা তানভীর ও তাঁর স্ত্রী জেসমিনকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তাঁরা দুজনই মাথা নিচু করে থাকেন এবং বেশ কিছু সময় কোনো কথা বলেননি।
২০১৬ সালের ২৭ মার্চ এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচার চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের মোট ৫৭ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে ৫২৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকার রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করে দুদক।
ওই বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায় যে, হল-মার্ক গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে তিন হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
২০১২ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পেয়ে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করে দুদক।
আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে আরও কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, শত কোটি টাকার বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি ও তিন হাজার কোটি টাকার জনতা ব্যাংক-ক্রিসেন্ট গ্রুপ ঋণ কেলেঙ্কারি।
এছাড়া নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারের ১০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট, ডেসটিনি গ্রুপের গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ ও যুবকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা দেশের আর্থিক কেলেঙ্কারির উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।