ঢাকায় কাওয়ালি গানের আসরে হামলা, প্রতিবাদ সমাবেশও পণ্ড
2022.01.13
ঢাকা

ঢাকায় কাওয়ালি গানের অনুষ্ঠানে সরকারি ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচি পুলিশ পণ্ড করেছে বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
যদিও ছাত্রলীগ ও পুলিশের পক্ষ থেকে হামলায় জড়িত থাকার কথা পৃথকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজক পিপলস এক্টিভিস্ট কোয়ালিশনের (প্যাক) সংগঠক রাতুল মোহাম্মদ মুঠোফোনে বেনারকে জানান, “বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসিতে কাওয়ালি গানের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে আমরা বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় শাহবাগে ধিক্কার সমাবেশের আয়োজন করেছিলাম।”
“ব্যানার খুলে দাঁড়াতেই পুলিশ আমাদের বাধা দেয়, লাঠিপেটা করে,” বলেন রাতুল।
এই হামলায় তিনজন আহত হওয়ার কথা বেনারকে জানান প্যাকের সংগঠক শিমুল চৌধুরী।
হামলার কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার সাংবাদিকদের বলেন, কাউকে লাঠিপেটা করা হয়নি।
করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণ ঠেকাতে “সরকারি বিধিনিষেধ অনুযায়ী সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ,” জানিয়ে তিনি বলেন “সমাবেশ করতে আসলে আমরা তাদের নিষেধ করেছি। পরে তারা শাহবাগ মোড় ত্যাগ করে।”
কাওয়ালি গানের অনুষ্ঠানে হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় না নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
এদিকে পুলিশ বৃহস্পতিবার বিকেলে মানববন্ধন পণ্ড করার পর সন্ধ্যায় টিএসসি এলাকায় আবার কাওয়ালি গানের আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাওয়ালি গানের দল ‘সিলসিলা’, যাদের বুধবার টিএসসিতে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি।
ছাত্রলীগেরও অস্বীকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে সঞ্জীব চত্বরে বুধবার কাওয়ালি গানের ওই অনুষ্ঠান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলায় পণ্ড হওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “শরিয়া ও তরিকা অনুযায়ী কাওয়ালি সহি কি না, নারীরা আসতে পারবেন কি না, এভাবে গান আয়োজন করা ঠিক কি না—এসব নিয়ে আয়োজকদের মধ্যে এক ধরনের সংঘর্ষের আবহ ছিল।”
“এর সঙ্গে ছাত্রলীগের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মনগড়া ও কল্পনাপ্রসূত,” যোগ করেন তিনি।
যদিও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামালের সাক্ষরিত বিবৃতিতে সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ওঠা এবং সাদ্দামের অভিযোগ প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
হামলা ‘শাপে বর’ হতে পারে
ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে জনপ্রিয় কাওয়ালি গান নিয়ে ঢাকায় এই হট্টগোলের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কড়া সমালোচনা শুরু হয়েছে। গত মাসে টিএসসি এলাকায় কাওয়ালি আয়োজনের ঘোষণা আসার পর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাটি ‘শাপে বর’ হতে পারে দাবি করে ‘সিলসিলা’-র প্রতিষ্ঠাতা লুৎফর রহমান বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয় কাওয়ালির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে।”
ভারত থেকে আসা উর্দুভাষী কাওয়াল পরিবারে ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া নাদিম কাওয়াল শৈশব থেকেই কাওয়ালি গাইছেন। পণ্ড হওয়া অনুষ্ঠানটিতে তাঁরও গান পরিবেশনের কথা ছিল। সেখানে জনতার ঢল দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন।
“হামলার পর থেকে কাওয়ালির বিষয়টি মিডিয়ায় যেভাবে আসছে, সেভাবে আগে কখনো আসেনি,” বেনারকে বলেন তিনি।
এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রথমবারের মতো কাওয়ালি শোনার কথা লিখেছেন অনেকে। এমন এক ফেসবুক ব্যবহারকারী হোসেন ইমাম সোহেল ইউটিউব ঘেঁটে কাওয়ালি শোনার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, “আগে কখনো কাওয়ালি শুনিনি আমি।”
জনপ্রিয় রকব্যান্ড বাংলা ফাইভের গায়ক সিনা হাসান ফেসবুকে লিখেছেন, “যারা বলে কাওয়ালি উর্দু, তাই গাওয়া যাবে না, আর যারা বলে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলে তাঁর গান জাতীয় সংগীত হতে পারে না, এরা মূলত একই দল।”
জঙ্গিবাদের উত্থানে কাওয়ালরা কোণঠাসা
বাংলাদেশের কাওয়ালদের দাবি, উদারপন্থী সুফিবাদী ইসলামি সংস্কৃতির অংশ কাওয়ালি গান, যা দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে কয়েক দশক ধরে কোণঠাসা হয়ে আছে।
৫২ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম কাওয়ালের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে কাওয়ালি ও সুফিগান করছেন।
বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, গত দশকে মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকদের পাশাপাশি সুফিবাদী অনেকেও জঙ্গিদের ‘টার্গেট কিলিং’-এর শিকার হয়েছেন।
যে কারণে সারা দেশের দরগাগুলোতে কাওয়ালিসহ সব ধরনের গানবাজনা কমে গেছে। আগে তরিকাপন্থীরা নিজেদের বাড়িতে প্রায়ই এমন আয়োজন করতেন।
“এখন মাজারগুলোতে ওরস হলেও আর আগের মতো রাতভর গান হয় না। এমন অবস্থার মধ্যে করোনা মহামারি এসে যেটুকু হতো, তা-ও শেষ করে দিয়েছে,” বলেন সিরাজুল।
তিনি শুধু কাওয়ালি করে সংসার চালাতে পারেন না, এর বাইরেও কাজ করতে হয় তাঁকে।
কাওয়ালরা জানান, বাংলাদেশের উর্দুভাষীরা স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন এবং স্থানীয় শিল্পীরা মূলত উর্দু কাওয়ালিই বেশি গাইতেন। যে কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জৌলুস হারাতে থাকে কাওয়ালি গান।
“এটা ঠিক যে, স্বাধীনতার পরে কাওয়ালি আগায়নি। অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। কিন্তু এদেশে এর একটি পরম্পরা আছে। সংস্কৃতিচর্চার মূলধারায় স্থান না পেলেও বহু মানুষ আজও এই গান শোনে,” বেনারকে বলেন সিলসিলার লুৎফর।
উর্দু-ফার্সির পাশাপাশি বাংলা কাওয়ালিও রয়েছে বলে জানান লুৎফর। সিরাজুল বলেন, “পাকিস্তানের মতো প্রাণঘাতী হামলার শিকার না হলেও এখানকার কাওয়ালরাও প্রায়ই ঝামেলার মুখোমুখি হয়।”
তিনি জানান, অনুষ্ঠানের জন্য দাওয়াত করে নিয়ে জোরপূর্বক বাহাসে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটে। তর্ক করতে গিয়ে কট্টর শরিয়তপন্থীরা অনেক সময় মারমুখীও হয়ে ওঠে। এসব খবর গণমাধ্যমেও আসে না।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছু বাংলা কাওয়ালি লিখেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাওয়ালি পছন্দ করতেন বলে উল্লেখ রয়েছে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে।