বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে
2022.10.14
ঢাকা

চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ও মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হওয়া মশাবাহিত এই রোগের চতুর্থ স্ট্রেন (ধরন) মৃত্যুর সংখ্যা বাড়াতে বড়ো ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ডেঙ্গু ভাইরাসের এই নতুন ধরন চিহ্নিত হবার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাসে একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় চারবার আক্রান্ত হতে পারেন, যার কোনো কোনোটি চরম আকার ধারণ করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক দিনে আরো ৩১০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
সব মিলে চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাড়ে সাত হাজার ডেঙ্গু রোগী। চলতি বছর এ রোগে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২৩ হাজার ৫৯২ জন।
প্রাণহানি ঘটাচ্ছে নতুন ধরন
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ার পেছনে রয়েছে একটি নতুন ধরনের হানা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক বলেন, “ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে এ বছর তিনটি ধরনই সক্রিয়। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির এটি অন্যতম কারণ।”
বর্তমানে সক্রিয় তিনটি সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২ এবং ডেন-৪) কারণে এ বছর বেশি প্রাণহানি ঘটছে বলে বেনারকে জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন।
“আমরা দেশে প্রথমবারের মতো ডেন-৪ সেরোটাইপ খুঁজে পেয়েছি। ডেঙ্গু রোগীদের প্রায় ১০ শতাংশ এটি বহন করছেন,” বলেন শিরিন।
দেশের ৯০ শতাংশ রোগী ডেন-৩ বহন করছে এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রোগীরা ডেন-১ বহন করছেন বলে জানান তিনি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় বিপুল সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
এই হাসপাতালের চিকিৎসক এইচ এম নাজমুল আহসান বেনারকে বলেন, “যেসব রোগী ডেন-৩ বহন করছেন তাঁরা সবাই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগী।”
এই ধরনের রোগীদের অনেকের নিয়মিত পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট না আসলেও তাঁদের ডেঙ্গু জ্বরের সমস্ত লক্ষণ রয়েছে বলে জানান তিনি।
নাজমুল বলেন, ডেন-৩ সেরোটাইপের ক্ষেত্রে রোগীদের রক্তচাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে এবং রোগীদের মুখ, নাক এবং মলদ্বার থেকে রক্তপাত হয়।
ডেন-৪ এ আক্রান্ত রোগীর অবস্থা ডেন-৩ এর তুলনায় গুরুতর হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে রোগীর অ্যালবুমিন (এক ধরনের প্রোটিন) কমে যায়। এটি হলে রোগীর অবস্থা খুব দ্রুত খারাপের দিকে চলে যায়।
সংক্রমণ বাড়া বিপজ্জনক
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসার কথা থাকলেও এবার যেভাবে অক্টোবরে এসেও তা বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে নভেম্বর নাগাদ রোগী বাড়তেই থাকবে।
“যেভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এ বছর,” বেনারকে বলেন চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব।
“ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সার্বিক ব্যর্থতা রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমত সিটি কর্পোরেশনগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি এবং দ্বিতীয়ত জনসাধারণও যথেষ্ট সচেতন হয়নি।”
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর পেছনে দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে, দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং হাসপাতালের অদক্ষতা।”
ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বেনারকে বলেন, রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুর এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
“মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা নিয়মিত অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড স্প্রে করছি,” বলেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবিরও দাবি করেন, প্রতিটি ডেঙ্গু রোগীর ৫০০ গজ এলাকায় বিশেষ কর্মসূচি নিচ্ছেন তাঁরা।
সংক্রমণ বাড়ছেই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, শুক্রবার নতুন কোনো মৃত্যুর সংবাদ না পাওয়া গেলেও বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় বছরের সর্বোচ্চ আটজন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু রোগে কমপক্ষে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে। যার মধ্যে, ঢাকা মহানগরীতে ৪৫, নারায়ণগঞ্জ জেলায় একজন, চট্টগ্রামে ৩২ জন এবং বরিশাল বিভাগে ৫ জন মারা গেছেন।
অক্টোবরের দুই সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা পুরো বছরে ভর্তি হওয়ার রোগীর প্রায় ৩২ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সরকারি তথ্য মতে, সেপ্টেম্বর মাসে ৯ হাজার ৯১১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আগস্টে রোগীর সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৫৭১। এর আগে জুলাই মাসে এক হাজার ৫৭১, জুনে ৭৩৭, মে মাসে ১৬৩, এপ্রিলে ২৩, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ২০ এবং জানুয়ারিতে ১২৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়।
এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রাক-বর্ষা মৌসুমের মশা জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেশি। তখন বলা হয়েছিল, প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এই বছর ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আব্দুল্লাহর মতে, “এবার থেমে থেমে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় এডিস মশা বেশি এবং এর ফলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তও হচ্ছে বেশি।”
আক্রান্তদের মধ্যে শিশুর সংখ্যার বেশি জানিয়ে এই চিকিৎসক বেনারকে বলেন, এই সময়ে জ্বর হলে করোনা ও ডেঙ্গু দুটিরই পরীক্ষা করা উচিত।
জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বলে জানান এই চিকিৎসক।