মালয়েশিয়ায় আটক খায়রুজ্জামানকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে

জেসমিন পাপড়ি
2022.02.10
ঢাকা
মালয়েশিয়ায় আটক খায়রুজ্জামানকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে শুনানির জন্য ঢাকার এক আদালতে হাজির হচ্ছেন ১৯৭৫ সালের জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামি এম. খায়রুজ্জামান। আদালত তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৪।
[এএফপি]

মালয়েশিয়ায় আটক বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার এম. খায়রুজ্জামানকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। খায়রুজ্জামান ১৯৭৫ সালের জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন, যদিও আদালত তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়।

দেশে আনার পর সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে জেলহত্যা মামলায় পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে এমন ইঙ্গিতও দেন শাহরিয়ার আলম, যদিও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি তিনি।

এর আগে বুধবার মালয়েশিয়ার আমপাং, সেলাঙ্গর এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খায়রুজ্জামানকে আটক করে দেশটির পুলিশ। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সেখানে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন এম খায়রুজ্জামান।

“আমরা আশা করছি, তাঁকে (খায়রুজ্জামানকে) দ্রুত এখানে ফেরত আনা হবে। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় মিলে সিদ্ধান্ত নেবে, মামলাটি কোন পর্যায় থেকে, কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হবে বা পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে।”

“আমি যতদূর জানি, সেই (জেলহত্যা) মামলায় তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। সেটা তদন্তের দুর্বলতা হতে পারে, অন্যকিছুও হতে পারে। এটি আদালতের এখতিয়ারে, বিচার বিভাগের বিষয়, আমি মন্তব্য করতে চাই না,” বলেন শাহরিয়ার আলম।

তিনি বলেন, “তাঁকে সশরীরে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করার এবং এই মামলাটিকে আবারও খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে কি নেই, সেটা আইন মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।”

“অভিবাসন সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের জন্য” খায়রুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে বলে বুধবার মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেদেশের বাংলাদেশ হাই কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানায় বলে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

তিনি জানান, “মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ইস্যুতে যাদের আটক করা হয়, তাঁদের নিজ নিজ দেশে ডিপোর্ট করার জন্য ডিপোর্টেশন সেন্টারে অন্তরীণ করে রাখা হয়, তাঁকেও (খায়রুজ্জামান) সেখানে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে।”

খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়া কী ধরনের আইন লঙ্ঘন করেছেন জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, “দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কোনো একটা আইন লঙ্ঘনের কথা বলেছে।” তবে সে বিষয়ে বিস্তারিত তাঁর জানান নেই বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

নয় মাস পাকিস্তানের জেলে কাটিয়ে স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মোটর শোভাযাত্রা থেকে জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বামপাশে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ৭৫’র আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার পর নভেম্বরে তাজউদ্দীন আহমেদসহ চার জাতীয় নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। [এপি]
নয় মাস পাকিস্তানের জেলে কাটিয়ে স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মোটর শোভাযাত্রা থেকে জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বামপাশে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ৭৫’র আগস্ট শেখ মুজিব হত্যার পর নভেম্বরে তাজউদ্দীন আহমেদসহ চার জাতীয় নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। [এপি]

জেল হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি

সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যার পর ওই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমেদ (মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী), এম. মনসুর আলী (মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী) এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানকে (মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী) হত্যা করা হয়।

এরপর দীর্ঘ ২১ বছর এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। মামলার বিচারে ২০০৪ সালে পলাতক তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের রায়ে বাকি দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের রায়ে তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে পলাতক থাকায় তাঁদের কারও সাজা কার্যকর করা যায়নি।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর খায়রুজ্জামান জেলহত্যা মামলার আসামি থাকলেও ২০০৪ সালে তাঁকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি সরকার তাঁকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে পাঠায়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা মামলার অভিযোগপত্রে নাম এলে সে সময় ফিলিপাইনে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা খায়রুজ্জামানকে দেশে ডেকে আনে। সে বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।

পরে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে খায়রুজ্জামান জামিনে মুক্তি পান। ২০০৩ সালের ৪ মে তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের হাই কমিশনার পদে খায়রুজ্জামানকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর খায়রুজ্জামানকে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। কিন্তু দেশে না ফিরে তিনি কুয়ালালামপুর থেকে জাতিসংঘের শরণার্থী কার্ড নেন এবং সেখানেই থেকে যান।

“তিনি তখন থেকেই পলাতক,” বলেন শাহরিয়ার আলম।

মালয়েশিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী সুমিতা সান্থিনি বেনারকে বলেন, “মালয়েশিয়া শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তাই শরণার্থীদের কোনো সুরক্ষা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। মালয়েশিয়ায় ইউএনএইচসিআরের উপস্থিতি মানবিক কারণে।”

“তবে আইনজ্ঞদের যুক্তি হচ্ছে, আশ্রয় চাওয়ার অধিকার প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। তাই কোনো রাষ্ট্রের প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের নীতি লঙ্ঘন করা উচিত নয়। এ কারণেই বলা হয় মালয়েশিয়া বহুবার ইউএনএইচসিআর কার্ডধারীদের বিতাড়িত করে প্রথা ও আইন লঙ্ঘন করেছে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের অনুরোধেই আটক

বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদিন খায়রুজ্জামানকে আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের অনুরোধেই তাঁকে আটক করা হয়েছে বলেও ইঙ্গিত দেন।

পুত্রজায়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাইনুদিন বলেন, “বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতকে আটক করা হয়েছে আইন অনুযায়ী।”

আটকের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ রয়েছে এবং আটকের বিষয়ে তাঁর দেশের একটি অনুরোধ রয়েছে।”

এ বিষয়ে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।

তবে মালয়েশিয়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বেনারকে জানায়, দেশটির অভিবাসন বিভাগ বাংলাদেশি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে।

“হ্যাঁ, তাঁকে (খায়রুজ্জামান) গতকাল (বুধবার) সকালে আটক করা হয়েছে, এবং তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তাঁকে আটকে অভিবাসন বিভাগ বাংলাদেশি পুলিশকে সহায়তা করেছে,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন মালয়েশিয়া সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এদিকে সরকারিভাবে খায়রুজ্জামানের অবস্থান খোঁজার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, “শুধু এটা নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আমরা অব্যাহতভাবে খুঁজি।”

“আমরা জানতাম, তিনি (খায়রুজ্জামান) মালয়েশিয়ায় আছেন, মালয়েশিয়া থেকে বের হতে পারেননি। পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ যেমন আশ্রয় দেয় অপরাধী বা তথাকথিত অপরাধীদের, মালয়েশিয়ায় তেমন সুযোগ নেই,” বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

এদিকে মালয়েশিয়ার এক মানবাধিকার কর্মী খায়রুজ্জামানের ইউএনএইচসিআরের কার্ডের একটি ছবি টুইটারে শেয়ার করেছেন; যাতে কার্ডের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেখা আছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে নিশা ডেভিড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।