খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া আটকে দিলো মালয়েশিয়ার আদালত
2022.02.15
কুয়ালালামপুর

মালয়েশিয়ার হাইকোর্টের আদেশে আটকে গেছে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম খায়রুজ্জামানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া, যাকে ১৯৭৫ সালের জেল হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে সরকার দাবি করছে।
“তবে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মালয়েশিয়া সরকারই আদালতে লড়াই করবে,” মঙ্গলবার জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
“মালয়েশিয়া সরকারের সাকসেসফুলি উইন করার জন্য যদি কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই সেটা করবে,” ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন শাহরিয়ার আলম।
খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রিটা রহমানের আবেদনের প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়ার হাইকোর্ট মঙ্গলবার তাঁকে স্বদেশে পাঠানোর বিষয়ে সাময়িক স্থগিতাদেশ দেয়।
বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালতের এই আদেশ মেনে চলার জন্যেও সরকারকে নির্দেশ দেন কুয়ালালামপুর হাইকোর্টের বিচারক মহম্মদ জাইনি মাজলান।
রিটার আইনজীবী এডমন্ড বন বেনারকে বলেছেন, “এর আগে আমাদের একটি মামলায় সরকার আদালতের রায় উপেক্ষা মিয়ানমারের নাগরিকদের একটি দলকে ফেরত পাঠিয়েছিল।”
“গত বছর সামরিক অভ্যুত্থানের মাত্র এক সপ্তাহ পরে শিশুসহ মিয়ানমারের এক হাজারেরও বেশি নাগরিককে তাঁদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল সরকার,” বলেন তিনি।
স্থানীয় দৈনিক ফ্রি মালয়েশিয়া টুডেকে এই আইনজীবী বলেছেন, “আমি আশা করি অভিবাসন পুলিশ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবে না।”
সংক্ষিপ্ত আদেশে আদালত বলেছে, “আইনজীবীদের বক্তব্য শুনানির পর এবং যেহেতু বিবাদীর কোনো আপত্তি নেই, তাই আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত একটি অস্থায়ী স্থগিতাদেশ দেওয়া হলো।”
এ বিষয়ে শুনানির জন্য ২০ মে পরবর্তী তারিখ ঠিক করে আদালত এই সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষকে হলফনামাসহ লিখিত বক্তব্য দাখিল এবং তা পারস্পরিকভাবে বিনিময় করার জন্য নির্দেশ দেন।
রিটা রহমান তাঁর নিয়োগকৃত একদল আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদনপত্র দাখিল করেন বলে প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন এডমন্ড বন।
রিটা তাঁর আবেদনে বলেছেন, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার কার্ড থাকা সত্ত্বেও তাঁর স্বামীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি দেশটির অভিবাসন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন খায়রুজ্জামান।
তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য কুয়ালালামপুরকে অনুরোধ করেছিল ঢাকা।
খায়রুজ্জামান এখনো আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি বলে বেনারকে জানিয়েছেন এডমন্ড বন।
“তবে তাঁকে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা অভিবাসন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি,” বলেন তিনি।
বেনারনিউজ রিটার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর ফোন নম্বর সংগ্রহের চেষ্টা করলে ঘনিষ্ঠজনদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিনি নিরাপত্তার কারণে মামলার বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।
তাঁরা বাংলাদেশে আছেন দাবি করলেও নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বেনারকে বলেছে, “খায়রুজ্জামানের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। মামলাটি সংবেদনশীল হওয়ায় তাঁরা মিডিয়ার সঙ্গেও কথা বলবে না।”
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ।
হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সেনা সমর্থিত নতুন সরকার সেনাবাহিনী থেকে মেজর খায়রুজ্জামানের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে।
আওয়ামী লীগের অভিযোগ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সামরিক শাসক এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানই খায়রুজ্জামানকে রক্ষার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে বিদেশ পাঠিয়ে দেন।
সে বছরই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করে সেনা সদস্যরা।
নিহতরা হলেন; বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও একই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান।
একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুনে ক্ষমতায় এসে জেলহত্যার বিচার শুরু করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। এই হত্যা মামলায় আসামী হন খায়রুজ্জামান। ২০০৪ সালে বিচারিক আদালতে জেলহত্যা মামলার রায়ে বেকসুর খালাস পান তিনি।
জেল হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করে আসছেন খায়রুজ্জামান।
২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে তাঁকে নিয়োগ দেয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে খায়রুজ্জামানকে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। কিন্তু তিনি ফিরে না এসে শরণার্থী হিসাবে মালয়েশিয়ায় থেকে যান।
তিনি মালয়েশিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) মাধ্যমে দেশটিতে শরণার্থী হিসেবে থাকার জন্য পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন
এরপর থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি শরণার্থী হিসেবে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন। দেশে ফিরে না আসায় একপর্যায়ে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাতিল করা হয়।
প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।