বাংলাদেশের অনুরোধে মালয়েশিয়ায় আটক খায়রুজ্জামান বিনাশর্তে মুক্ত, চলে যাবেন যুক্তরাষ্ট্র

নিশা ডেভিড ও সুগন্য লিঙ্গন
2022.02.16
কুয়ালালামপুর
বাংলাদেশের অনুরোধে মালয়েশিয়ায় আটক খায়রুজ্জামান বিনাশর্তে মুক্ত, চলে যাবেন যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের আটককেন্দ্র থেকে মুক্তি পাবার পর পুত্রজায়ায় নিজের আইনজীবী ও বন্ধুদের সাথে সাবেক রাষ্ট্রদূত খায়রুজ্জামান (বামে) ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[সৌজন্যে: খায়রুজ্জামান]

দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে মালয়েশিয়ায় আটক হলেও বুধবার বিনাশর্তে মুক্তি পেয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম খায়রুজ্জামান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে পরিবারের সাথে বসবাস করবেন তিনি।

এদিকে খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরাতে সরকার সব ধরনের আইনি প্রচেষ্টা চালাবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে জেলহত্যার মামলায় সরকারের দৃষ্টিতে তিনি সন্দেহভাজন, যদিও ২০০৪ সালে আদালতের রায়ে ওই মামলার অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন তিনি।

“ওই হত্যাকাণ্ডে (জেলহত্যা) আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা ছিল না। ওই ঘটনায় আমার কোনো সংযোগ থাকলে আমি রাষ্ট্রদূত হতে পারতাম না,” বুধবার বেনারকে বলেন খায়রুজ্জামান।

তিনি বলেন, “যদি আমার সম্পৃক্ততা থাকত, তবে কি মালয়েশিয়া আমাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গ্রহণ করত?”

“আমার বিরুদ্ধে তাদের (সরকারের) হাতে কোনো প্রমাণ নেই, সবকিছুই রাজনৈতিক এজেন্ডা,” বলেন তিনি।

বুধবার মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের ডিপোর্টেশন সেন্টার থেকে বিনা শর্তে মুক্তি পেয়েছেন সাবেক এই কূটনীতিক। এর প্রতিক্রিয়ায় এদিন ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা খবরটা পেয়েছি। যত ধরনের আইনি প্রক্রিয়া আছে, সেগুলোতে আমরা প্রচেষ্টা চালাব।”

তবে এ বিষয়ে মালয়েশিয়ায় আইনজীবী নিয়োগ করা হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমি জানি না।”

খায়রুজ্জামানকে ফেরত আনতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে কাজ করছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে মঙ্গলবার এক আদেশে তাঁর প্রত্যর্পণ আটকে দেয় মালয়েশিয়ার আদালত। এর পর দিনই তাঁকে মুক্তি দেয় দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ।

খায়রুজ্জামানকে কোন কারণে মুক্তি দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে আদালত কিছু জানায়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী জিও চো ইং।

তিনি বলেন, “দুপুর একটায় তদন্ত কর্মকর্তা ফোন করে জানান, তাঁকে (খায়রুজ্জামান) ছেড়ে দেওয়া হবে। কোনো শর্ত ছাড়াই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।”

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ায় শরণার্থী হিসেবে বসবাস করে আসা খায়রুজ্জামানকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার আমপাং, সেলাঙ্গর এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। খায়রুজ্জামানকে আইন অনুসারে আটক করা হয়েছিল বলে তখন জানিয়েছিলেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজাহ।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য কুয়ালালামপুরকে অনুরোধ করেছিল ঢাকা।

যুক্তরাষ্ট্র যাবেন খায়রুজ্জামান

মুক্তি পাবার পর খায়রুজ্জামান বেনারকে জানান মালয়েশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র যাবার জন্য কিছু কাগজপত্রের অপেক্ষা করছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে রয়েছেন বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “আমি এখন মালয়েশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে পরিবারের সাথে বসবাস করার জন্য কিছু কাগজপত্রের অপেক্ষা করছি।”

“গত ১৭ বছর ধরে এখানে একাই রয়েছি আমি,” বলেন খায়রুজ্জামান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ। হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সেনা সমর্থিত নতুন সরকার সেনাবাহিনী থেকে মেজর খায়রুজ্জামানের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সামরিক শাসক এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে বিদেশ পাঠিয়ে দেন।

সে বছরই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করে সেনা সদস্যরা। নিহতরা হলেন; বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও একই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান।

একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুনে ক্ষমতায় এসে জেলহত্যার বিচার শুরু করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। এই হত্যা মামলায় আসামি হন খায়রুজ্জামান।

২০০৪ সালে বিচারিক আদালতে জেলহত্যা মামলার রায়ে খালাস পান তিনি। জেল হত্যার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করে আসছেন খায়রুজ্জামান।

২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে তাঁকে নিয়োগ দেয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে খায়রুজ্জামানকে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। কিন্তু তিনি ফিরে না এসে শরণার্থী হিসাবে মালয়েশিয়ায় থেকে যান।

সরকার যখন ২০০৯ সালে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিল তখন দেশে যাননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে খায়রুজ্জামান বলেন, তিনি জানতেন শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিকভাবে তাঁকে টার্গেট করবে, তাই যাননি।

“আমি ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফেরত যেতে চাইনি কারণ, আমি জানতাম, তারা আমাকে আবার অভিযুক্ত করবে,” বেনারকে বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রে না যাওয়া পর্যন্ত খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়াতেই থাকবেন বলে বেনারকে জানান তাঁর আইনজীবী জিও চো ইং।

মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের আটককেন্দ্র থেকে মুক্তি পাবার পর পুত্রজায়ায় নিজের আইনজীবী ও বন্ধুদের সাথে সাবেক রাষ্ট্রদূত খায়রুজ্জামান (ডান থেকে দ্বিতীয়।) ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২। [সৌজন্যে: জিও চো ইং।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের আটককেন্দ্র থেকে মুক্তি পাবার পর পুত্রজায়ায় নিজের আইনজীবী ও বন্ধুদের সাথে সাবেক রাষ্ট্রদূত খায়রুজ্জামান (ডান থেকে দ্বিতীয়।) ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২। [সৌজন্যে: জিও চো ইং।

রাজনৈতিক কারণে হয়রানি

বুধবার ছাড়া পাবার পর খায়রুজ্জামান বেনারের কাছে ১৯৭৫ সালের জেলহত্যার ঘটনার সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়ে বাংলাদেশর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা, এবং বাংলাদেশের আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে আমি নির্দোষ।”

তিনি বলেন, “অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাবার পরেই আমি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।”

তাঁর মতে, তাঁর প্রয়াত শ্বশুরের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই বর্তমান সরকার তাঁকে হয়রানি করছে।

“এই কারণেই আমার সাথে এমন ব্যবহার করা হচ্ছে। সবগুলো অভিযোগই সম্পূর্ণ মিথ্যা,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, তাঁর স্ত্রী রিটা রহমান বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে।

রিটা রহমান ২০১৮ সালে বিএনপির প্রতীকে সংসদ নির্বাচন করে হেরে যান। খায়রুজ্জামানের গ্রেপ্তার রাজনৈতিক কারণে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন রিটা রহমানও।

এছাড়া “রাজনৈতিক কারণেই” বাংলাদেশ খায়রুজ্জামানকে ফেরত নিতে চাচ্ছে বলে গত সোমবার মন্তব্য করেছিলেন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফিল রবার্টসন।

গত সপ্তায় খায়রুজ্জামানের আটকের পর থেকেই জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশনারসহ বিভিন্ন এনজিও তাঁকে বাংলাদেশে না পাঠানোর জন্য মালয়েশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল।

খায়রুজ্জামানের কাছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি শরণার্থী কার্ড রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরও দেশটিতে বসবাসের কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছিল, যদিও খায়রুজ্জামানের শরণার্থী মর্যাদা সম্পর্কে তাঁরা কোনো মন্তব্য করেননি।

যে দেশে গেলে কোনো শরণার্থীর জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকিতে পড়তে পারে নীতিগতভাবে সেখানে কাউকে ফেরত পাঠানো যায় না বলে জানিয়েছিল ইউএনএইচসিআর।

ঢাকা থেকে প্রতিবেদন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।