র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: ভুক্তভোগী ও অধিকারকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ
2022.04.08
ঢাকা

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার পর থেকে বাংলাদেশে ভুক্তভোগীদের স্বজন ও মানবাধিকারকর্মীরা নানা রকম হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
শুক্রবার (বাংলাদেশ সময়) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হয়, তা নিবিড়ভাবে মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
একটি ফাঁস হওয়া সরকারি নথির বরাত দিয়ে সংস্থাগুলো বলছে, গত ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে কিছু এনজিওর বিদেশি তহবিলের বিষয়ে নিবিড় মনিটরিং করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওই নথির একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্টসহ কিছু এনজিওর বিদেশি তহবিলের বিষয়ে নিবিড় মনিটরিং করতে হবে।”
এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও সংস্থাটির কয়েকজন বর্তমান-সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য ও ব্যাপক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
“নিষেধাজ্ঞার পর থেকে র্যাব ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ভুক্তভোগী ও মানবাধিকারকর্মীদের ফোনে হুমকি দিচ্ছে, স্থানীয় অফিসে তাঁদের ডেকে পাঠাচ্ছে, তাঁদের কর্মস্থল ও বাড়িতে মধ্যরাতে হানা দিচ্ছে বলে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে,” বলা হয় এতে।
একটি ঘটনার উল্লেখ করে বিবৃতিতে জানানো হয়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের শুরুর দিক পর্যন্ত র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা এক মানবাধিকারকর্মীর আত্মীয়কে হয়রানি করেছে। এমনকি গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে সমর্থন করায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
“বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও টার্গেট করছে,” উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার মানবাধিকার কর্মীদের তাঁদের কাজের জন্য হয়রানি করতে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ ও আদালতকে ব্যবহার করছে।
গুমের শিকারদের পরিবারের আয়ের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে র্যাব অফিসাররা মধ্যরাতে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন বলে এক মানবাধিকার কর্মীর বরাত দিয়ে জানানো হয় বিবৃতিতে।
র্যাব অফিসাররা তখন এই কর্মীর কর্মস্থল পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের এই বলে হুমকি দেন যে “তথ্য গোপন করলে নিজের জন্য আরও সমস্যা হবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
হয়রানির অভিযোগ সঠিক নয়: আইনমন্ত্রী
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ মানবাধিকারকর্মী ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা সমর্থন করলেও এসব অভিযোগ মানতে নারাজ সরকার।
বিবৃতিতে আনা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিদেশি তহবিল মনিটরিং এর বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।
“তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, হয়রানির যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়, কারণ আমাদের (বাংলাদেশের) পলিসি নির্যাতন বিরোধী,” বলেন আইনমন্ত্রী।
বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ “স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা রকম অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি ঠিক বলতে পারব না, এসব অভিযোগও সেরকম কোনো অপপ্রচারের অংশ কিনা।”
এইচআরডব্লিউ এর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তাঁরা এই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে সক্রিয় সহযোগিতার কারণে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড দ্রুত বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানান।
১২টি সংগঠনের বরাত দিয়ে এইচআরডব্লিউ বলে, অবিলম্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভুক্তভোগী, মানবাধিকারকর্মী ও তাঁদের পরিবারের বিরুদ্ধে হয়রানি ও প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম বন্ধ করে চলমান গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পূর্ণ জবাবদিহি নিশ্চিতে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
‘চাপ সৃষ্টি’
যাদের বিরুদ্ধে “মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ তাদের জবাবদিহির আওতায় না এনে উল্টো মানবাধিকারকর্মী, মানবাধিকার সংগঠন, ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারকে হয়রানি করা খুবই দুর্ভাগ্যজনক,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান।
তাঁর মতে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়া র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশের উচিত দেশটি যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রশ্রয় দেয় না, তা প্রমাণ করা।
“আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হওয়া প্রতিটি গুম ও তথাকথিত ক্রসফায়ারের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের দায়িত্ব,” বলেন এলিনা খান।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশের সব ধরনের আইন কানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা “এমনিতেই বিভিন্ন সংস্থার নানা রকম প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নজরদারির মধ্যে কাজ করেন,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন নূর খান লিটন।
তাঁর মতে, এরপরও যখন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, সংগঠনগুলোর বিদেশি তহবিল ‘নিবিড় মনিটরিং’ করবে তখন এটিকে “মানবাধিকারকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি বলে মনে হয়।”
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সভাপতি আফরোজা ইসলাম আঁখি বেনারকে বলেন, “তহবিল মনিটরিং এর সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র মানবাধিকারকর্মী ও ভুক্তভোগীদেরকে চাপে রাখার জন্য সরকারের একটি কৌশল মাত্র।”
র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো নতুন করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
বিবৃতি দেয়া ১২টি আন্তর্জাতিক সংগঠন হলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপেয়ারেন্সেস, এশিয়া ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন্স, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, সিভিকাস, ইলিওস জাস্টিস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জাতিসংঘের উদ্বেগের প্রতি সাড়া দেওয়ার জন্য এবং র্যাবের সাথে কাজ করেছেন এমন কাউকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে, বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
গত ডিসেম্বরে প্রায় ৬০০ মানুষকে গুম করার অভিযোগ থাকা র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে দেশে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সূত্রে।
দেশে সর্বশেষ ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছিলো গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বরিশালে, যখন পর্যন্ত র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার খবরটি আসেনি।
আসকের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে ৫১টি। তার মধ্যে ৩০টি ঘটিয়েছে র্যাব।