জামিন পেয়েছেন ঝুমন দাশ, তবে জেলার বাইরে গেলে লাগবে আদালতের অনুমতি
2021.09.23
ঢাকা

নিম্ন আদালতে বারবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে এক বছরের জামিন পেয়েছেন সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাশ আপন।
রায় ঘোষণার পরে হাইকোর্টে ঝুমনের অন্যতম আইনজীবী মো. আশরাফ আলী ঢাকার সাংবাদিকদের জানান, এক বছর মেয়াদি জামিনের শর্তমতে ঝুমন দেশের বাইরে যেতে পারবেন না, নিজ জেলা সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে হলে তাঁকে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।
প্রায় ছয়মাস ধরে বন্দি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের এই যুবকের মুক্তির সুযোগ তৈরি হওয়ায় স্বজনেরা আনন্দিত হলেও তাঁরা ঝুমনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বলে জানিয়েছেন।
“আমার মাসহ স্বজনেরা ঝুমনকে দেখার অপেক্ষায় আছে। তবে এলাকায় থাকলে তার ঝুঁকিও আছে। আমরা খুব শিগগির নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন জানাব,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন ঝুমনের বড়ো ভাই নূপুর চন্দ্র দাশ।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন আদেশের ‘সার্টিফাইড কপি’ হাতে আসার পর ঝুমনের মুক্তির জন্য চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পিটিশন দেবেন জানিয়ে নিম্ন আদালতে ঝুমনের আইনজীবী এবং সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর দেবাংশু শেখর দাস বেনারকে জানান, “আগামী রবি বা সোমবারের আগে তাঁর মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।”
সুনামগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মোট পাঁচবার ঝুমনের জামিনের আবেদন নাকচ হয়। গত ২২ আগস্ট জামিন চেয়ে উচ্চ আদালতে যান ঝুমনের পরিবার।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও কেএম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ গত মঙ্গলবার শুনানি শেষ করে আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে।
ফেসবুকে হেফাজতে ইসলামের আলোচিত নেতা মামুনুল হককে সমালোচনার জন্য পুলিশের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় ঝুমনকে। তার আগে সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁকে আটক দেখানো হয়। সেই মামুনুল হকও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার একাধিক মামলায় বর্তমানে জেলে রয়েছেন।
এদিকে কারাবন্দি ঝুমনের মুক্তির দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
ঝুমনের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার সবার প্রতি পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন ঝুমনের ভাই নূপুর চন্দ্র দাস।
“যারা লেখালেখি করে, গান গেয়ে, মিছিল-সমাবেশ করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারা আগামীতেও আমাদের পরিবারের পাশে থাকবেন- এমনটাই প্রত্যাশা করি,” বলেন নূপুর।
ঝুমন ফেসবুকে হেফাজত নেতা মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ তুললে ক্ষেপে যান হেফাজতে ইসলামের স্থানীয়া অনুসারীরা। তাঁরা ১৬ মার্চ রাতে হিন্দু পল্লী নোয়াগাঁও আক্রমণ করার চেষ্টা করে। তখন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে তাদের শান্ত করেন।
পরদিন ১৭ মার্চ সকালে মাইকে ঘোষণা দিয়ে শাল্লা উপজেলার কাশিপুর এবং দিরাই উপজেলার নাসনি, সন্তোষপুর ও চন্দ্রপুর গ্রামের কয়েক হাজার মুসলিম আটটি পারিবারিক মন্দিরসহ প্রায় ৯০ টি হিন্দু বাড়ি ভাংচুর করে।
এ ঘটনায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার ১০৫ আসামির সবাই জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই শঙ্কায় রয়েছে ঝুমনের পরিবার। যদিও সুনামগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বেনারকে জানিয়েছেন, নোয়াগাঁওয়ের সংখ্যালঘুদের নিরাপদে রাখতে সতর্ক রয়েছেন তারা।
আতঙ্কে গৌরাঙ্গের পরিবার
ঝুমনের জামিন মিললেও স্বস্তি মেলেনি বলে বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করা সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর নেতারা।
ভোলায় সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক পীড়নের ঘটনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন।
দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড়ো সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “অনেক লড়াইয়ের পরে ঝুমনের জামিন হলেও আমাদের আনন্দ প্রকাশ করার উপায় নেই।”
“ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইসলামের নবী সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ কথোপকথনের ‘স্ক্রিনশট’ ছড়িয়ে পড়ায়” গত সপ্তাহে ভোলার পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি গৌরাঙ্গ চন্দ্র দে’কে ঝুমনের মতোই সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঝুমনের মুক্তির দাবিতে সক্রিয় প্রগতিশীল প্ল্যাটফর্ম নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ অন্যতম সংগঠক খান আসাদুজ্জামান মাসুমও বেনারকে বলেন, “ভোলার ঘটনার পর ঝুমনের জামিনে স্বস্তিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সাম্প্রদায়িক উসকানিতে গ্রেপ্তার, হামলা-ভাংচুর কোনো নতুন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।”
“সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের মতো আমরাও সংক্ষুব্ধ। এর প্রতিবাদে সবাইকে যৌথভাবে সোচ্চার হয়ে রাজপথে থাকতে হবে,” উল্লেখ করেন তিনি।
গৌরাঙ্গ “এখনো সন্দেহভাজন হিসেবেই বন্দি আছেন,” জানিয়ে ভোলা থেকে তাঁর ছেলে সীমান্ত চন্দ্র দে বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমরাও নিরাপত্তার অভাবে তাঁর জামিনের আবেদন করিনি।”
“তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি যে সাজানো তা প্রমাণ হওয়ার আগে তিনি কারামুক্ত হলে ঝামেলা হবে। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ পুলিশ তাঁকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না,” বলেন তিনি।
“পুলিশ আমাদের বাসাটি সার্বক্ষণিক পাহারা দিলেও পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে রয়েছেন,” সীমান্ত উল্লেখ করেন।