দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চাপ সামলাতে হিমশিম ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র

আহম্মদ ফয়েজ
2022.02.22
ঢাকা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চাপ সামলাতে হিমশিম ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্র রাজধানীর মিন্টো রোড এলাকায় ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে থেকে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য কিনছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাঝে ভর্তুকিতে পণ্যপ্রাপ্তির আশায় সরকারি ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে নিম্ন আয়ের মানুষদের লাইন যখন দিনে দিনে বড়ো হচ্ছে, তখনই আসন্ন রমজান মাসে এক কোটি মানুষকে স্বল্পমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

অপরদিকে, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেওয়া থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার কৌশল বের করতে মঙ্গলবার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না বলেই মানুষের কষ্ট ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।”

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের তুলনায় দেশে সয়াবিন তেলের লিটার প্রতি দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ। এ ছাড়া কেজি প্রতি চালের দাম ২৩ শতাংশ, আটা ২৪ শতাংশ, মশুর ডাল ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।

দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তে শুরু করলেও গত কয়েক সপ্তাহে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম। বিশেষ করে, সরকারি ভর্তুকিমূল্যে পণ্য দেয়া টিসিবির ট্রাকগুলোর সামনে দেখা যাচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের উপচে পড়া ভিড়।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিলেও সাধারণ মানুষ দুষছে সরকারের ব্যর্থতাকে।

এক কোটি মানুষকে কম মূল্যে নিত্যপণ্য দেওয়ার ঘোষণা

গত রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটা সত্য। আর তাই ভর্তুকি দিয়ে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে সরকার।”

তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে রমজান মাস উপলক্ষে ৫০ লাখ মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য দেবার চিন্তা করা হলেও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন “এক কোটি মানুষকে সেই আওতায় আনতে।”

রমজান মাসকে সামনে রেখে পেঁয়াজ, তেল, ডাল, চিনি, খেজুর ও ছোলা-এ ছয়টি পণ্য সরবরাহ করা হবে বলে জানান তিনি।

“আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কারণে দেশে তেলের দাম বাড়ছে। কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের বাইরে যেন বিক্রি না হয়, সে বিষয়টি দেখছে সরকার,” বলেন মন্ত্রী।

টিসিবির ট্রাক: চাপ সামাল দিতে হিমশিম

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সাড়ে চারশো ট্রাকের মাধ্যমে চারটি নিত্যপণ্য বাজার দামের তুলনায় কম মূল্যে বিক্রি করছে। প্রতিটি ট্রাকের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ১৭০০ কেজি পণ্য বিক্রি করা হয়।

রাজধানীর বাসাবো, মালিবাগ ও সেগুনবাগিচা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব ট্রাকের সামনে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা লম্বা লাইনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন পণ্য পাওয়ার জন্য।

টিসিবির ট্রাকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। অপর দিকে খোলা বাজারে এই পণ্যগুলো বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ১৬৮-১৭২ টাকা, ১০০-১০৫ টাকা, ৮০-৮৫ টাকা এবং ৩৮-৪৫ টাকা ৷

২০২০ সালের মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে লকডাউন দেওয়া হলে সাধারণ মানুষ চরমভাবে অর্থকষ্টে পড়ে এবং তার প্রেক্ষিতে সরকার টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘ট্রাক-সেল’ শুরু করে। মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর গত জানুয়ারি থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য আবারও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় একটি ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন ৬৫ বছর বয়সী আমেনাতুন্নেছা। রোববার বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, তিনদিন এখানে এসে লাইনে দাড়িয়েও চিনি ও ডাল পাননি তিনি।

“আজকে অনেক সকালে এসেছি। এখন লাইনের কাছাকাছি, আশা করি আজকে পাব। আমাদের খুব কষ্ট। কোনো কাজ নেই, ঠিক মতো খাবার জোগাড় করতে পারছি না,” যোগ করেন তিনি।

বাসাবো এলাকায় টিসিবির বিক্রয়কর্মী আসাদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে জিনিসপত্রের জন্য যত মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছে আমাদের কাছে তত পণ্য থাকে না। মানুষের চাপ সামাল দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।”

তিনি বলেন, “আমরা চাপ সামাল দেয়ার জন্য এই এলাকায় এক ট্রাকের মালামাল দুই ভাগে দুই স্থান থেকে দেই, তবুও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।”

গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা, তখন সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিয়েছে নতুন করে গ্যাস,পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর।

গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে গ্যাসের দাম। একই সময়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। গত ১২ বছরে পানির দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

গত জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বিদ্যুতের বিইআরসির কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬৬ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা ওয়াসার বিশেষ বোর্ড সভায় তোলা হয়েছে পানির দাম আরেক দফা বাড়ানোর প্রস্তাব। এ দফায় সংস্থাটি পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

বোর্ড সভায় গৃহীত প্রস্তাবের একটি কার্যপত্র বেনারের হাতে রয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা গত দুই বছরে দুবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সব মিলিয়ে ১৩ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার।

“বর্তমানে পানির যে মান তা কোনো ক্রমেই সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যে প্রতিবছর এক বা একাধিকবার পানির দাম বাড়ছে, এটা সাধারণ মানুষের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা ছাড়া কিছুই নয়,” বেনারকে বলেন রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান।

“বাজান নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উপর্যুপরি মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ নাকাল হয়ে পড়ছে,” মন্তব্য করে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “সরকারের উচিত বিষয়টির দিকে সঠিকভাবে নজর দেওয়া এবং এর থেকে মানুষের পরিত্রাণ নিশ্চিত করা।”

ভর্তুকি থেকে সরে আসার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের জানান, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেওয়া থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার কৌশল বের করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“প্রাথমিকভাবে বড়ো বড়ো শিল্প খাতের গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে বলেছেন। এছাড়া ভর্তুকি কমানোর কৌশল বের করতে বলেছেন তিনি,” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।