ডলার সংকট: সমস্যায় নিত্যপণ্য আমদানি

রিয়াদ হোসেন
2023.03.08
ঢাকা
ডলার সংকট: সমস্যায় নিত্যপণ্য আমদানি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর একটি ঘাটে আমদানিকৃত পণ্য খালাস করছেন শ্রমিকরা। ২৯ নভেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলায় সমস্যার কারণে আসন্ন রমজান মাসের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর কারণ হিসেবে ব্যাংকগুলো বলছে ডলার সংকটের কথা।

এই সমস্যার সমাধান চেয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ লিমিটেড। ওই চিঠির অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।

ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণপত্র খুলতে না পারায়” তেল, চিনি, গম, সয়াবিনসহ আসন্ন রমজান মাসের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান।

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৪ মার্চ থেকে দেশে রমজান শুরু হবে। প্রতি বছর রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি ফল ও মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়।

ঋণপত্র খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা চেয়ে ফজলুর রহমান বলেছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং এলসি সেটেলমেন্টের সময় প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের নিশ্চয়তা দিলে এলসিগুলো দ্রুত খোলা যাবে এবং বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে।”

ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ৪ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ আমদানির চুক্তি হয়েছে বলেও চিঠিতে জানানো হয়। সেই সঙ্গে যে ২৮টি ব্যাংকের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক, তাদের নামও উল্লেখ করা হয়।

সিটি গ্রুপ যে ২৮টি ব্যাংকের তালিকা দিয়েছে, তাতে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নামও রয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে গ্রাহকদের চাহিদা মতো এলসি খুলতে পারছি না। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই।”

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও তিন মাস সময় লাগবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে “নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।”

এলসি খোলার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা চাওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বেনারকে জানান ঋণপত্র “ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কের বিষয়। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো মন্তব্য নেই।”

তিনি বলেন, “নিত্য পণ্য যা দরকার, তা আমদানি হচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানমতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথমার্ধে চাল ও গম আমদানি কমেছে যথাক্রমে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে চিনি আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ। তবে ভোজ্য তেল ও মসুর ডাল আমদানি বেড়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে আমদানি শুল্ক আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় এক শতাংশ।

ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতি

রাজধানীর পুরান ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীদের অন্যতম বড়ো সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বেনারকে বলেন, “শুধু তেল, চিনি, দুধ, ডালের বাইরেও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য রয়েছে। সেগুলোর জন্য এলসি খুলতে গেলে ব্যাংক খুলছে না। তারা বলছে ডলার সংকটের কথা।”

আর সরকার বলছে, যে কোনো জিনিস আমদানি করা যাবে, ডলারের সংকট নেই। অথচ খেজুর, মসলা, গুঁড়ো দুধের এলসি খুলতে গেলে বলা হচ্ছে ডলার নেই,” যোগ করেন তিনি।

ডলার অলরেডি বাজারে ১১৫ টাকা হয়ে গেছে, যা বাড়তে পারে। এটা সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি,” বলেন বশির উদ্দিন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা, গত এক বছর আগে যা ছিল ৮৪ টাকা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “এলসি না খোলার বিষয়টি ব্যবসায়ীদের অজুহাতও হতে পারে। ক’দিন আগে একটা মিটিংয়ে বাণিজ্য সচিব বলেছেন, কেউ সমস্যায় পড়লে তাদের জানালে তারা সমাধান করে দেবেন।”

বাংলাদেশে ডলারের সংকট শুরু হয় প্রায় এক বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও পণ্যমূল্য বেড়ে গেলে ডলারের টান পড়তে শুরু করে।

ডাল, তেল, গমসহ বেশ কিছু খাদ্য-শস্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় এবং শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা সাপেক্ষে দাম বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতিরও রেকর্ড তৈরি হয়।

সরকারি হিসেবে, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়, যা গত এক যুগে ছিল সর্বোচ্চ। পরবর্তী মাসগুলোতে কিছুটা কমে এলেও এখনো অতীতের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের হিসাব (৩ মার্চ) অনুযায়ী, গত এক বছরে আটার দাম ৫৬ শতাংশ, সয়াবিনের দাম ১১ শতাংশ ও ছোলার দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এই সময়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ৪২ শতাংশ বেড়েছে।

একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে রমজান মাসে চিনি ও ভোজ্য তেলের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। সারা বছরে ছোলা ও খেজুরের মোট চাহিদার অর্ধেকই থাকে রমজান মাসে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।