বৈদেশিক মুদ্রা সুরক্ষা: বিলাস সামগ্রী আমদানি ও বিদেশ ভ্রমণে লাগাম

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.05.11
ঢাকা
বৈদেশিক মুদ্রা সুরক্ষা: বিলাস সামগ্রী আমদানি ও বিদেশ ভ্রমণে লাগাম মিয়ানমার থেকে আমদানি করা মিঠাপানির মাছ ঢাকার আড়ত থেকে কিনে ফেরিঘাটে নৌকায় উঠছেন একজন ফেরিওয়ালা। ৯ এপ্রিল ২০০৫। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিলাস সামগ্রী আমদানির ওপর লাগাম টানার ঘোষণা দিলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি শিথিল থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
[রয়টার্স]

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, বিলাস সামগ্রী আমদানি ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর লাগাম টানার ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তাফা কামাল।

বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে মন্ত্রী জানান, সকল বিলাস সামগ্রী আমদানি আপাতত বন্ধ থাকবে, যেসব উন্নয়ন প্রকল্প এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করলে অর্থনীতিতে চাপ পড়বে না সেগুলো পিছিয়ে দেয়া হবে এবং কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করা হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈরি বৈশ্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই ঘোষণা দিলেন মুস্তাফা কামাল।

এ বছর রপ্তানি আয় এবং আমদানি ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আমদানির ওপর বাড়তি শর্ত দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার জারি করার পর দিনই সরকারি এই ঘোষণা আসলো।

অপরিহার্য দ্রব্যে বাধা নেই

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বুধবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে আ.হ.ম. মুস্তাফা কামাল বলেন, “সময় যখন কঠিন আপনাকে তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। … বিশ্বের যে সার্বিক অবস্থা সেই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এখান থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “অপরিহার্য দ্রব্য যেগুলো মানুষের না হলেই নয়, নিত্যদিনের প্রয়োজন সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কোনো হাত দিচ্ছি না। সেগুলো আনইনটারাপটেড থাকবে।”

“লাক্সারি আইটেম আমরা এখন না কিনে দুই মাস পরে কিনতে পারি, ছয় মাস পর কিনতে পারি। যেসব প্রকল্প আমরা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন না করলে অসুবিধা নেই, সেগুলো আমরা ডিফার করে দেবো পরবর্তী সময়ের জন্য। এইভাবে আমরা এখানে রিস্ট্রাকচারিং করছি,” বলেন মন্ত্রী।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এক্সক্লুসিভলি যদি কৌশলগত কারণ অথবা বিশেষ কারণে যেতে হয় তাহলে যাবেন। অন্যথায় যাবেন না। এটিই সিদ্ধান্ত।”

অর্থমন্ত্রী বলেন, “ইউক্রেন এবং রাশিয়ায় যে যুদ্ধ লেগেছে সেটি কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারে না। কারণ একটাই। এই মুহূর্তে কোভিড নেই। এখন কেবলমাত্র যুদ্ধের প্রভাবটি বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে এবং এই নিয়ে সবাই কষ্ট পাচ্ছে।”

তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প এখন না করে ছয় মাস পরে করলে সমস্যা হবে না, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ক্ষতি হবে না এবং জিডিপিতে ক্ষতি হবে না সেসব প্রকল্প আমরা ডিফার করাচ্ছি।

আগেই করা উচিত ছিল

“ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে,” জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে “ভালো সিদ্ধান্ত” হিসেবে আখ্যায়িত করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা সরকারকে বার বার বছরের পর বছর ধরে বলে আসছি, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিন, প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন। সরকার এতদিন আমাদের কথা শোনেনি। তবে দেরিতে হলেও সরকারের বোধোদয় হয়েছে।”

তিনি বলেন, “মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবার নিয়ে সদলবলে বিদেশ যাত্রা বন্ধ করার কথাও আগেই বলেছিলাম। এতে অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ে।”

“আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ কমছে। এক বছর আগে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। বর্তমান সময়ের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এর কারণ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি,” জানান ড. মোস্তাফিজুর।

তিনি  বলেন, “চলতি অর্থবছরে রপ্তানি থেকে আয় হবে ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানিতে ব্যয় হবে ৮৫ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, বাণিজ্য ঘাটতি হবে ৩৫ বিলিয়ন ডলার যা দেশের ইতিহাসে কখনও হয়নি।”

আমদানি খরচ বৃদ্ধির মূল কারণ “আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি” জানিয়ে তিনি বলেন, “এই প্রবণতা কবে বন্ধ হবে সেব্যাপারেও কিছু বলা যাচ্ছে না।

“এই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস সামগ্রী আমদানির জন্য এলসি খোলার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সেটিও ভালো সিদ্ধান্ত। আমরা আশা রাখি আগামী বাজেটেও এর প্রতিফলন থাকবে,” বলেন তিনি।

চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের “রপ্তানি বেড়েছে ৩৩ ভাগ। কিন্তু আমদানি বেড়েছে ৪৪ ভাগ,” বলে বেনারকে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম।

তবে তাঁর মতে, “আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, ক্রমবর্ধমান পূঁজি পাচার।”

“আমদানিকারকেরা মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে পূঁজি পাচার করার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে,” বলেন মঈনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমরা অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছি। এই ঋণগুলোর সুদ পরিশোধ শুরু হবে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে। তখন যদি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে তাহলে কিন্তু আমাদের অবস্থা ভালো হবে না।”

বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকার মতো নয় জানিয়ে তিনি  বলেন, “শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয় এবং পর্যটন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। “তবে শ্রীলংকার ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষা।”

“সরকার আমদানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেটি আরো আগেই করা উচিত ছিল,” বলেন অধ্যাপক মঈনুল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার

মঙ্গলবার জারি করা সার্কুলারে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ হলো, ২০২০ এবং ২০২১ সালে আমদানি কম হয়েছে এবং অনেক আমদানির মূল্য পরিশোধ করা হয়নি, যা এই অর্থবছরে পরিশোধ করা হচ্ছে।”

“আবার সারাবিশ্বে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সেকারণে আমাদের বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে,” বলেন সিরাজুল ইসলাম।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জারি করা সার্কুলার বুধবার থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সার্কুলার অনুযায়ী, বিলাস সামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারককে শতকরা ৭৫ ভাগ অর্থ ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হবে। বাকি অর্থের গ্যারান্টি দেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।

বেনারের হাতে আসা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, মোটর কার, ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানির ক্ষেত্রে শতকরা ৭৫ ভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।

এতে বলা হয়, শিশুখাদ্য, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ও সরঞ্জামসহ চিকিৎসা সামগ্রী, উৎপাদনমুখী স্থানীয় শিল্প ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সরাসরি আমদানিকৃত মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল, কৃষিখাত সংশ্লিষ্ট পণ্যসহ অন্যান্য অগ্রাধিকারমূলক পণ্য ছাড়া সকল অপরিহার্য নয় এমন আমদানির ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।