নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংলাপের আহ্বান
2024.01.04
ঢাকা

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)।
“জানুয়ারির নির্বাচন বিলম্বিত করার জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে,” উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত “নির্বাচনের চেয়েও অধিকতর: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ভাঙা” শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আইসিজি বলছে, “দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে ভোটের পরে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ছাড়ের মাধ্যমে কাজ করা উচিত। বিদেশি অংশীদারদের উচিত দলগুলোকে সেই লক্ষ্যে উৎসাহিত করা।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নিজ তত্ত্বাবধানে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন।”
এতে আরও বলা হয়, “যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার আওয়ামী লীগের সংকল্প বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে অবক্ষয় সাধন করেছে। গত এক দশকে শেখ হাসিনা আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের অনুগত লোকদের এসব জায়গায় নিয়োগের মাধ্যমে।”
শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী কর্মী, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “নিরাপত্তা বাহিনী শতাধিক গুম ও কয়েক হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। আরও অনেক কর্মীকে অন্তহীন মামলায় আদালতে দৌড়াতে হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে নতুন কঠোর আইনে করা মামলা।”
ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক পিয়েরে প্রকাশ বলেন, “৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করবে না। যদিও ভোট স্থগিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার বিরোধীদের ভোটের পর আবার আলোচনার টেবিলে বসার প্রচেষ্টা অধিকতর জোরদারের বিষয়কে আরও যৌক্তিক করে তোলে।”
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে “আর কোনো বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন হয়নি,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যদিও বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, বিশেষত অর্থনৈতিক খাতে এবং দারিদ্র কমানোর ক্ষেত্রে। একই সময়ে দেশটি ক্রমাগত রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নাগরিক স্বাধীনতার অবদমনের মুখে পড়েছে।”
“দুটি প্রধান দলের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাংলাদেশকে গণতন্ত্র, শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। এটি নতুন রাজনৈতিক সহিংসতা এড়াতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
প্রকাশ বলেন, “গত কয়েক মাসে কয়েক ডজন লোক নিহত হয়েছেন। এটি (গণতন্ত্র, শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফেরা) বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য এবং এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উন্নতিতেও সাহায্য করবে।”
‘শর্ত ছাড়া’ সংলাপে রাজি আওয়ামী লীগ
আইসিজির সংলাপের আহ্বান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বেনারকে বলেন, কোনো পূর্বশর্ত ছাড়া বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে তাঁর দল সব সময় ইতিবাচক।
“আইসিজি প্রতিবেদনটিতে কী সুপারিশ করেছে তা আমরা এখনো দেখিনি। তবে আমাদের অবস্থান খুবই পরিষ্কার, কোনো শর্তহীন সংলাপ হলে আমরা স্বাগত জানাই,” বলেন তিনি।
আবদুর রহমান আরও বলেন, “এই নির্বাচনের আগে সংলাপ না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, বিরোধীরা প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছিল।”
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, “দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা কারাগারে থাকায় আগামী নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা কঠিন।”
“সরকার এখন প্রহসনমূলক নির্বাচনের জন্য বেপরোয়া। তারা পরবর্তী সংসদে বিরোধী দলও তৈরি করছে। অতীত ও বর্তমান সরকারের মতো আগামী সরকারও গুরুতর বৈধতা সংকটের মুখোমুখি হবে,” বলেন এই বিএনপি নেতা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, তিনি ক্রাইসিস গ্রুপের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত।
“পরবর্তী সরকারের বৈধতা সংকট নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং একটি সমাধান হওয়া আবশ্যক, যা কেবলমাত্র প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমেই সম্ভব,” যোগ করেন তিনি।
আইসিজি রিপোর্টের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, “রিপোর্টটি সঠিকভাবে নির্দেশ করেছে যে, শেখ হাসিনা তাঁর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সিভিল সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে বিরোধীদের দুর্বল করেছেন।”

ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর করবে
আইসিজি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ৭ জানুয়ারি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বাড়াতে পারে এবং এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা প্রকট।
“বিএনপি সম্ভবত তার অবরোধ চালিয়ে যেতে পারে এবং নির্বাচনের পরে একটি নতুন দফা বিক্ষোভ শুরু করতে বামপন্থি, মধ্যপন্থি ও ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারে। এটি সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দিকে থেকে দমনমূলক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখা কঠিন প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “সামনে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের মে মাসে মাত্র নয় দিনে আন্তঃদলীয় সহিংসতায় ১২ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক নিহত হয়েছিলেন।
নির্বাচনের আসন বণ্টন ও অন্যান্য ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ার আরও ঝুঁকি রয়েছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “শেখ হাসিনার সরকার দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানকে ‘ধ্বংস’ করেছে এবং নির্বাচনের পর বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিকসহ অনেক সংকট অপেক্ষা করছে।”
ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ না করার আহ্বান
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘একসেস নাও’ এর নেতৃত্বে বিশ্বের ১০৫টি দেশের ৩০০র বেশি সংগঠনের জোট ‘কিপইটঅন কোয়ালিশন’ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরবর্তী সময় দেশের সবার জন্য অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এতে বলা হয়, “৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরবর্তী সময়ে ইন্টারেনটসহ সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের বাধাহীন ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আপনাদের প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতির আহ্বান জানাচ্ছি।”
আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে টেলিকম প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ যাতে জনগণের ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা না দেয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও জানানো হয় ওই বিবৃতিতে।