জাতীয় নির্বাচন ‘একপাক্ষিক’ বলে সরকারের তোপের মুখে টিআইবি

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.01.18
ঢাকা
জাতীয় নির্বাচন ‘একপাক্ষিক’ বলে সরকারের তোপের মুখে টিআইবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন এক নারী। ৭ জানুয়ারি ২০২৪।
[সুদীপ্ত সালাম/ বেনারনিউজ]

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘একপাক্ষিক ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ বলে প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই ক্ষমতাসীন দল, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের তোপের মুখে পড়েছে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের টিআইবিকে “বিএনপির দালাল” বলে অভিহিত করেছেন।

পৃথক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, কোনো প্রকার গবেষণা ছাড়াই প্রতিবেদন তৈরি করে প্রকাশ করেছে টিআইবি। তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত টিআইবির প্রতিবেদনকে পক্ষপাতমূলক বলে অভিহিত করেছেন।

সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, তাঁদের প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ।

গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একপাক্ষিক ও পাতানো প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে; অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গন ও শাসনব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জবাবদিহিহীন প্রয়োগের পথ আরও প্রসারিত হয়েছে।

সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের কড়া সমালোচনা

টিআইবিকে “বিএনপির দালাল” আখ্যায়িত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, “তাদের প্রত্যেকটা কথা একপেশে, তারা ওকালতি করে। তারা সরকারবিরোধী।”

বিএনপি যে ভাষায় কথা বলে, টিআইবিও সেই ভাষায় কথা বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “টিআইবি সব সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল। সব সময় বিএনপির পক্ষপাত করে। ...তাদের গবেষণায় নিরপেক্ষতা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।”

বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে টিআইবি পর্যবেক্ষণে জানায়, বিএনপির বয়কটের মধ্যে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন “অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক” হয়নি।

সংস্থাটির গবেষণা অনুসারে, এই নির্বাচনের সার্বিক অভিজ্ঞতা “বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।”

“বিএনপির ভাষা আর টিআইবির ভাষা মিলে গেছে,” উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিআইবি গবেষণা না করেই শ্যালো কিছু বিষয় বা পত্রিকার রিপোর্ট এবং তড়িঘড়ি করে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেটার ভিত্তিতেই প্রেস ব্রিফিং করে। গতকালেরটা আমার সে রকম মনে হয়েছে।”

“দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা বলছেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সুন্দর আর স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে। সেটিকে ম্লান করার উদ্দেশ্যে টিআইবি এই রিপোর্ট দিয়েছে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

নির্বাচন কমিশন যেভাবে “সুন্দরভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছে; সেটির বিন্দুমাত্র প্রশংসা টিআইবির রিপোর্টে নেই” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যখন রিপোর্ট কারও পক্ষে হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, তখন সেটি রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার কারোরই উপকারে আসে না। সেটি তখন বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে দাঁড়ায়।”

টিআইবি “অসত্য তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে,” মন্তব্য করে বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, “টিআইবি যেটা করেছে, সেটা গবেষণা না, এটা তাদের মতামত।”

তিনি বলেন, নির্বাচনে কিছু অনিয়ম হলেও নির্বাচন কমিশন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে তাদের মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরাফাত বলেন, “তারা মানুষের মতামতকে তথ্য হিসেবে দেখিয়েছে। ৪২ হাজার কেন্দ্র থেকে মাত্র ৫০টি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে পুরো নির্বাচন ঘিরে তৈরি রিপোর্ট কখনো সঠিক হতে পারে না। এত অল্প কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণ করে কীভাবে এমন রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব!”

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য: সিইসি

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচন খুব যে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে তা নয়। তবে এর মাধ্যমে জাতি একটি চলমান সংকট থেকে উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন’ অনুষ্ঠানে সিইসি এসব কথা বলেন।

নাম উল্লেখ না করে সিইসি বলেন, “দু–একটি সংস্থা বলেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত দিয়ে ইসি সরকারের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু আমি জানি না সরকারের সঙ্গে আসলেই কোনো গোপন এজেন্ডা নিয়ে কারো সমঝোতা হয়েছে কি না। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে আমার সঙ্গে হয়নি। অন্য কারো সঙ্গে হয়েছে কি না তা আমি জানি না।”

‍তিনি প্রশ্ন রাখেন, “সংস্থাগুলো বলেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছে। ইসি কীভাবে অজুহাত দিলো? তাদের সামনে কি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল না? তাহলে কী করা যেত? আমরা কি বলতে পারতাম যে, যেহেতু রাজনৈতিক ঐকমত্য হচ্ছে না, নির্বাচন আমরা আগামী ৩০ বছরের জন্য পিছিয়ে দেব?”

প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ: টিআইবি

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে এ ধরনের মন্তব্য ও সমালোচনা শুনে থাকি। এটি আসলে আমাদের পেশাগত বিড়ম্বনা। ”

“আমাদের গবেষণার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যাঁরা সরকারে থাকেন। যাঁরা ক্ষমতায় তাঁরা মনে করেন, সমালোচনার অর্থ হলো প্রতিপক্ষ। তাঁরা সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “অতীতেও আমরা দেখেছি, আমাদেরকে যাঁরা হুমকি দিয়েছেন, ৬৪ জেলায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলেছেন, দেশ থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলেছেন, টিআইবি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন, তাঁরাই এখন আমাদের প্রশংসা করছেন।

“আবার বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন আমাদের প্রতিবেদনের প্রশংসা করতেন। আমাদের গবেষণাকে উল্লেখ করতেন,” যোগ করেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ক্ষমতাসীনদের এমন বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের গবেষণায় বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে। ফলে দেশের মানুষ আরও বেশি বেশি আমাদের প্রতিবেদন দেখবে। এর মাধ্যমে তাঁরা আমাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন বলে আমি মনে করি।”

উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিযোগিতা করার অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ।

যাঁরা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি, তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে মোট ৬২ আসনে নৌকার প্রার্থীদের পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ জিতেছে ২২৩ আসন এবং ১১টি আসনে জয়লাভ করে তৃতীয় অবস্থানে আছে জাতীয় পার্টি।

নির্বাচন কমিশন জানায়, নির্বাচনে শতকরা প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।